জাহাজ নির্মাণের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ‘সুইচবোর্ড’। এটি দিয়ে জাহাজের যন্ত্রপাতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ হয়। এত দিন বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো এই সুইচবোর্ড। এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। এই সুইচবোর্ড তৈরির পথ দেখিয়েছেন একদল দক্ষ প্রকৌশলী। তাঁরা কর্ণফুলীর পাড়ে গড়ে তুলেছেন ‘ওশেন ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
সুইচবোর্ড বলতে শুধু ইস্পাতের বড় বাক্সে সাজানো বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জামের স্তূপের কথা ভাবলে ভুল হবে। জাহাজের সব সরঞ্জামের মতো সুইচবোর্ড তৈরির পদে পদে বৈশ্বিক মান বজায় রাখতে হয়। এটি নির্মাণের আগে নকশা করে সেটি অনুমোদন নিতে হয় আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে। সেই নকশা অনুযায়ী তা নির্মাণ হয়েছে কি না, তা সরেজমিন পরীক্ষা করে নিশ্চিত করেন আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। জাহাজে বসানোর পর চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হয়। প্রতিটি ধাপে মান নিশ্চিতের পরই মিলে চূড়ান্ত সনদ।
যেভাবে শুরু
সুইচবোর্ড তৈরির এমন সাফল্যের কথা জানতে সম্প্রতি শহর থেকে নদীপথে কর্ণফুলীর মাঝপথে যেতেই চোখে পড়ল কারখানাটির সাইনবোর্ড। ঘাটে নৌকা ভেড়াতেই হাতুড়ি পেটানো বা যন্ত্রপাতির শব্দ কানে বাজছিল। প্রায় ৩৫ হাজার বর্গফুটের জায়গায় অনেকগুলো শেডে চলছে নির্মাণযজ্ঞ। মোট ১২৫ জন কর্মীর ব্যস্ততা দেখা গেল কারখানাটিতে।
কারখানায় বসে উদ্যোক্তারা শোনালেন শুরুর কথা। সময়টা প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আগে। চট্টগ্রামের পটিয়ার কোলগাঁওয়ে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডে বৈদ্যুতিক বিভাগের প্রকৌশলীদের তখন পাঁচ-ছয় বছরের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। তাঁরা দেখলেন, বিদেশ থেকে সুইচবোর্ড আনতে গড়ে চার মাসের বেশি সময় লাগছে। নকশা প্রণয়ন থেকে নির্মাণ পর্যন্ত বিদেশি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শতাধিক ই-মেইল চালাচালি করতে হয়। সব প্রক্রিয়া শেষে রপ্তানিমুখী জাহাজে সুইচবোর্ড বসাতে খরচ ও সময় দুটোই বেশি লাগত।
কাজ করতে করতে সুইচবোর্ড তৈরির চিন্তা মাথায় আসে তাঁদের। প্রথমে তাঁরা ওয়েস্টার্ন মেরিনে কর্মরত অবস্থায় পাকিস্তানে রপ্তানি হওয়া দুটি যাত্রীবাহী জাহাজের জন্য সুইচবোর্ড তৈরি করেন। সাহসটাও তৈরি হয়ে যায় তখন। এরপরই ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে তাঁরা কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটায় গড়ে তোলেন কারখানা। তাঁদের এই উদ্যোগে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন।
এই উদ্যোক্তাদের একজন নৌ প্রকৌশলী এ এস এম আরিফুজ্জামান। তিনি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। বলেন, ২০১৩ সালের মার্চে প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানের ৪৫ জন দক্ষ কর্মী বাহিনী নিয়ে কোম্পানিটির যাত্রা শুরু। ব্যাংকের ঋণ ছাড়াই তাঁরা ১২ জন ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। এখন ক্রয়াদেশ দেওয়ার দেড়-দুই মাসের মধ্যে সুইচবোর্ড পাচ্ছে জাহাজ নির্মাণ কারখানাগুলো। খরচও পড়ছে আমদানির চেয়ে গড়ে ২৫-৩০ শতাংশ কম। এখন দেশি-বিদেশি ১৪টি জাহাজ নির্মাণ কারখানা তাঁদের কাছ থেকে সুইচবোর্ড নিচ্ছে। সাতটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান তাঁদের নির্মিত সুইচবোর্ডের মান সনদ দিয়েছে। দেশের পাশাপাশি ভারত ও সিঙ্গাপুরের ক্রেতাদের কাছে তাঁরা সুইচবোর্ড রপ্তানি করছেন।
প্রথম ক্রয়াদেশ
প্রায় পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দরের পানি পরিবহনকারী জাহাজ ‘জলপরী’ নির্মাণের দায়িত্ব পায় ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। এই জাহাজে প্রথম সুইচবোর্ড সরবরাহের ক্রয়াদেশ পায় কোম্পানিটি। এরপর প্রতিবছর বাড়তে থাকে ক্রয়াদেশ। চালু হওয়ার প্রথম বছরে পাঁচ কোটি টাকার কার্যাদেশ পায় প্রতিষ্ঠানটি। এভাবে বেড়ে এখন বছরে ১৩-১৪ কোটি টাকার কার্যাদেশ আসছে। জাহাজের আকারভেদে একেকটি সুইচবোর্ড তৈরিতে খরচ পড়ছে ২০ থেকে ৬০ লাখ টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক লে. কমান্ডার (অব.) এনামুল হক বলেন, গত পাঁচ বছরে ৫০টি জাহাজের সুইচবোর্ড তৈরি হয়েছে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। এখন কাজ চলছে ১০টির। দেশীয় জাহাজে (যেগুলো আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে নির্মিত) প্রায় শতভাগ সুইচবোর্ডের সরবরাহ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে শুধু সুইচবোর্ডেই থেমে থাকেননি উদ্যোক্তারা। জাহাজের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরিতেও হাত দিয়েছেন তাঁরা।