জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণের বিধান যুক্ত করতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনীর প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশনার মাহবুব তালুকদার প্রস্তাবটি অনুমোদনের আগেই আপত্তি জানিয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে কমিশন সভা বর্জন করেন। এই কমিশনার সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিধান যুক্ত করার প্রস্তাবে আপত্তির কারণ তুলে ধরেন। এ বিষয়ে তিনি তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। কারণগুলো হলো—প্রথমত বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল সংলাপের সময় ইভিএমের বিরোধী করেছিল, দ্বিতীয়ত, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য দক্ষ জনবল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় ইসির হাতে নেই ও তৃতীয়ত ভোটাররা এখনও ইভিএমে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।
আরপিও সংশোধনীর প্রস্তাব অনুমোদন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদার সংবাদ সম্মেলনের পরপরই মাহবুব তালুকদার তার দফতরে সাংবাদিকদের ডেকে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়ার কারণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি তিনটি কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছি। প্রথম বিষয় হচ্ছে অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে, দ্বিতীয়ত, ইভিএম ব্যবহারের জন্য কমিশন যাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তা অপর্যাপ্ত, জাতীয় নির্বাচনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে যে সময়ের দরকার হবে তা আমাদের হাতে নেই। আর তৃতীয়ত, ইভিএম ব্যবহারে ভোটারদের মধ্যে অনীহা রয়েছে। তাদের মধ্যে অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। এজন্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করাটা ঠিক হবে না।’
এ প্রসঙ্গে এই কমিশনার উল্লেখ করেন, ‘কমিশনের অবস্থান ছিল সব রাজনৈতিক দল না চাইলে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। এক্ষেত্রে আমাদের আগের কথাও তো রাখতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান কমিশন যদি মনে করতো যে, তারা ইভিএম ব্যবহার করবে, তাহলে প্রথম থেকেই ভোটারদের মধ্যে একটি অভ্যাস গড়ে তুলে পারতাম। দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে বৃহৎ একটি অংশকে এতদিনে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হতো।’
ইসির রোডম্যাপে ইভিএমের বিষয়টি নেই উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমরা যে কর্মপরিকল্পনা দিয়েছিলাম, তার কোথাও ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে কিছু নেই। এখন হঠাৎ করে নির্বাচনের আগে আগে কেন ইভিএম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে গেল?’ জার্মানিতে ইভিএমকে অসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে বলে তিনি পত্রিকার উদ্বৃতি দিয়ে দাবি করেন। ইভিএম ব্যবহারে সংবিধানে কোনও সংশোধনী আনার প্রয়োজন পড়বে কিনা, সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি।
ভোটারদের অভ্যস্ত না করলে ইভিএম কখনোই সফল হবে না মন্তব্য করে মাহবুব তালকুদার বলেন, ‘যন্ত্রের অগ্রগতির সময়ে আমি মোটেও ইভিএম ব্যহারের বিপক্ষে নই। কিন্তু আমি মনে করি, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে যে প্রস্তুতি দরকার, তা আমাদের নেই। স্থানীয় সরকারগুলোয় যেভাবে ইভিএম ব্যবহার হচ্ছে, তা বাড়ানো গেলে আশা করি, আগামী ৫/৭ বছরের মধ্যে ইভিএম ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে উঠবে। ফলে আগামী ৫ বা ১০ বছর পরে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম অনিবার্য হয়ে উঠবে।’ তিনি তার বিশ্বাস থেকে এই কথাগুলো বলেছেন বলে জানান।
ইভিএম ক্রয় বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো প্রকল্পে এই কমিশনারের সম্মতি ছিল না বলে দাবি করেন। এ বিষয়ে সিইসির বক্তব্য তুলে ধরনে এই কমিশনার বলেন, ‘সিইসির বক্তব্যের বিপরীতে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চান না।’ কমিশনের ভাবমূর্তি নষ্ট হোক তা চান না। তবে, কমিশনের কোনও সভার কার্যবিবরণীতে এই প্রকল্পের বিষয়টি রয়েছে বলে তার নজরে পড়েনি।
বৈঠক শেষ না করে বেরিয়ে আসার কারণ ব্যাখ্যা করে এই কমিশনার বলেন, ‘আমি আরপিও সংশোধনের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছি। আমি মোটেও চাই না, আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধন হোক। এখন তারা বসে বসে আরপিও সংশোধন করতে থাকবেন আর আমি নো অব ডিসেন্ট দিয়ে মূর্তির মতো সেখানে বসে থাকবো। তা আমার কাছে যথোপযুক্ত মনে হয়নি।’
নোট অব ডিসেন্ট প্রসঙ্গে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমি কারও বিরুদ্ধে এই নোট অব ডিসেন্ট দেইনি। একটা মতের বিরুদ্ধে আমার ভিন্নমত। আমি দ্বিমত বা ভিন্নমত পোষণ করতে পারি। তবে, কোনও সহকর্মী কারও সঙ্গে আমার মতবিরোধ নেই। কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে আমাদের দ্বিমত হতেই পারে। কিন্তু তা মতবিরোধ হিসাবে গণ্য করা ঠিক হবে না।’
একাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পথে এগিয়ে চলার ইসির অন্যতম সদস্য মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্বের সংবাদ গণমাধমে প্রকাশ হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম ছবক দিচ্ছে কমিশনকে। পত্রপত্রিকায় এমন সংবাদও বেরিয়ে যে, সিইসি ও আমার মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।’
একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হলে কী সিদ্ধান্ত হবে, তা ওই সময় নির্ধারণ করবেন বলে জানান এই কমিশনার। তখনকার অবস্থা কী হবে তা এই মুহূর্তে বলা যাবে না।’
এ সময়ে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে কমিশনের অবস্থানও তুলে ধরে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘পাঁচ নির্বাচন কমিশনার মিলে একক সত্তা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমরা সব কমিশনার দেশবাসীকে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে বদ্ধপরিকর। সাংবিধানিকভাবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেতন রয়েছি।’