‘ইউ আর ফায়ারড’ কিংবা ‘ফেক মিডিয়া’ ভাষ্যের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে একটি নতুন ও আপাত নিরীহ শব্দবন্ধ। আর তা হচ্ছে ‘এনিমি অব নান’। হ্যাশট্যাগ ‘মিটু’-এর মতো করে এটিও একটি আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘এনিমিঅবনান’ হ্যাশট্যাগ এক নতুন প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে। হ্যাঁ, বলা হচ্ছে আমেরিকার কথাই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গণমাধ্যমবিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে, মুক্তমত ও স্বাধীন ভয়হীন গণমাধ্যমের পক্ষে এ এক সম্মিলিত প্রতিবাদ।
এটা হওয়ারই ছিল। যেকোনো উপলক্ষ খুঁজে ওভাল অফিস থেকে যেভাবে একের পর এক তীর ছোড়া হচ্ছিল সংবাদমাধ্যম অভিমুখে, তাতে এমন যূথবদ্ধভাবে জেগে ওঠাটা সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। অবশ্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো মার্কিন গণমাধ্যম নীরবতাকে একমাত্র পাথেয় মনে করেনি কখনোই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা তারা করেছে খোলাখুলিই। কিন্তু ১৫ আগস্টের মতো করে একসঙ্গে কখনো আগে করেনি। বোস্টন গ্লোবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওই দিন আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় সাড়ে তিন শ পত্রিকা একযোগে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে।
২০১৬ সালে নির্বাচনে জয়ের আগে থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প আভাস দিচ্ছিলেন; আর নির্বাচনে জয়ের পর তিনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে, তিনি কোনো প্রেসিডেন্সি নয়, চান একটি সাম্রাজ্য। তিনি চান ওভাল অফিস থেকে যা-ই করা হবে, তাতেই ‘সাধু সাধু’ করবে সবাই। স্তাবকদের ভিড়েই তিনি সবচেয়ে বেশি স্বস্তিবোধ করেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজের স্তুতি শোনার জন্য তিনি যা যা করেছিলেন, তা এখনো মানুষ ভোলেনি। সেই বৈঠক এতটাই দৃষ্টিকটু ছিল যে, ইকোনমিস্ট শিরোনাম করেছিল—‘ডোনাল্ড ট্রাম্প: স্তুতি আসক্ত এক প্রেসিডেন্ট’। কিন্তু তাঁর সংবিৎ ফেরেনি। এদিকে হোয়াইট হাউসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভার সদস্যরা সবাই জেরবার। প্রেসিডেন্টের এমন প্রত্যাশা মেটানোর চেষ্টা কতক্ষণ করা যায়? না; ভুল মানুষকে, ভুল বয়ানকে মানুষ খুব বেশিক্ষণ সমর্থন করতে পারে না, বিনা বাক্যব্যয়ে; অন্তত এই সময়ের আমেরিকায় তো নয়ই। কারণ দেশটির আর যা-ই হোক গণতান্ত্রিক ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। ফলে ক্ষমতার মধুচন্দ্রিমাকাল কেটে যেতে না যেতেই ট্রাম্পকে শুনতে শুরু করতে হয় নানা সমালোচনা। কিন্তু তিনি সেসব শুনলে তো!
পরিণাম? ট্রাম্প যেন আবারও আয়েশ করে বসলেন তাঁর টিভি রিয়্যালিটি শো দা অ্যাপ্রেনটিসের বিচারকের আসনে। হোয়াইট হাউস যেন হয়ে উঠল তাঁর একার সাম্রাজ্য; আর বাকি সবাই তাঁর কৃপাপ্রার্থী। যতক্ষণ তাদের মুখে তাঁর জন্য আছে স্তুতি বাক্য, ততক্ষণ তারা ‘সর্বোৎকৃষ্ট সভ্যজন’; আর যখনই এর ব্যত্যয় ঘটে, ছুটে আসে কোনো সমালোচনা; শুনিয়ে দেওয়া হয় সেই অবধারিত বাক্য ‘ইউ আর ফায়ারড’। হোয়াইট হাউস ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বরখাস্ত কিংবা পদত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা ও তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেই এ কথার সত্যতা বোঝা যাবে।
এ তো গেল হোয়াইট হাউসের পরিস্থিতি। কিন্তু এর বাইরে? বলার অপেক্ষা রাখে না যে ট্রাম্প পারলে হয়তো হীরক রাজার মতো করে যন্তর-মন্তর স্থাপন করতেন এবং বেছে বেছে নিজের সমালোচকদের সেখানে ঢুকিয়ে বশে আনতেন। দলে দলে লোক সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে আওড়ে যেত মোক্ষম শ্লোক, ‘সাদা মনে ভাবে যে, অপঘাতে মরে সে’। কিন্তু সেটি সম্ভব হচ্ছে না। সম্ভব হচ্ছে না স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠ রুদ্ধ করার। এটা যে সম্ভব হবে না, তা তিনি শুরু থেকেই জানতেন। আর এ কারণেই ‘ফেক নিউজ’ বা ‘ফেক মিডিয়া’ শব্দবন্ধটিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন তিনি। তথ্যকে তিনি তথ্য দিয়ে মোকাবিলার বদলে বন্দী করতে চেয়েছেন।
সর্বশেষ ১৫ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তাঁরা চাইলে থাকতে কিংবা চলেও যেতে পারেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা মুক্ত। আর তাঁরা তো মুক্তমতের কথাই বলেন। নিঃসন্দেহে মোক্ষম যুক্তি। আবার নিদারুণ কটাক্ষও বটে! কিন্তু কটাক্ষটি কার প্রতি? সাংবাদিক নাকি সংবিধানের প্রতি? তাঁর জানা থাকার কথা যে, যে আমেরিকার তিনি প্রেসিডেন্ট, তার সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথাই বলা হয়েছে।
ফক্স নিউজের মতো অনুগত সংবাদমাধ্যম ব্যতীত বাকি সব সংবাদমাধ্যমকে ট্রাম্প তাঁর শত্রু মনে করেন। টুইটারে একের পর এক বিষ ঢেলে চলেন তিনি সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এটা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমেরিকার গণমাধ্যম এখন বিষয়টিকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছে। এই যে আশঙ্কা, এটিও কিন্তু হাওয়া থেকে জন্ম নেয়নি। কিছুদিন আগেই সরাসরি সম্প্রচারিত এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ফোন করা এক দর্শক ডন লেমন ও ব্রায়ান স্টেলার নামের দুই সিএনএন সাংবাদিককে গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। তাঁদের লেখা ও প্রকাশিত রাজনৈতিক অভিমতই তাঁদের অপরাধ। কারণ সেখানে ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনা ছিল।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন ট্রাম্প ‘ভুয়া খবর’ বা ‘ভুয়া সংবাদমাধ্যম’ ফিরিয়ে নেওয়ার কিংবা তাঁর প্রেস সচিব সারাহ স্যান্ডার্স গণমাধ্যমকে ‘জনগণের শত্রু’ বলে যে মন্তব্য করে যাচ্ছেন, তা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না; প্রত্যাখ্যান তো দূরের কথা। এ পরিস্থিতিতে আমেরিকার সংবাদমাধ্যমের পক্ষে আর চুপ থাকা সম্ভব হয়নি। বোস্টন গ্লোবের ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের পক্ষে তারা একযোগে প্রকাশ করেছে সম্পাদকীয়। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা ও আজকের আমেরিকার রূপকারদের বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে, সংবিধানের প্রথম সংবিধানের উল্লেখ করে তারা একটি কথাই বলেছে, ‘সংবাদমাধ্যম জনগণের শত্রু নয়। জনগণকে তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সম্প্রদায়কে নিয়ে গড়া দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখা ও তাদের নিযুক্ত সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য সংবাদমাধ্যম জরুরি। এই সংবাদমাধ্যমকে দায়িত্ব পালনে সহায়তা করতে সবার আগে চাই জনগণের সমর্থন।’
১৫ আগস্ট আমেরিকার সাড়ে তিন শ সংবাদপত্রে প্রকাশিত সম্পাদকীয়র মূল কথা ছিল এটিই। এই মূলভাষ্যের শেষ বাক্যটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদমাধ্যম যেন তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারে, সে জন্য পাশে থাকতে হবে জনগণকে। এ কথাটি এভাবে বলার কারণ হচ্ছে, ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন প্রতিনিয়ত ‘ভুয়া’ অভিধাটি গণমাধ্যমের গায়ের সঙ্গে সেঁটে দিয়ে জনগণের একটি অংশকে কিছু সুনির্দিষ্ট সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে চটিয়ে দিতে পেরেছে, যার ফল হিসেবে সিএনএন সাংবাদিককে টিভি লাইভে হত্যার হুমকি শুনতে হচ্ছে। ট্রাম্প ভালো করেই জানেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কোনো অপছন্দের সাংবাদিককে ইচ্ছামাফিক ‘ইউ আর ফায়ারড’ শোনাতে পারবেন না। এমনকি আমেরিকার মতো দেশে কোনো সংবাদপত্রকে শুধু প্রেসিডেন্ট ও তাঁর কাজের সমালোচনার দায়ে বন্ধ করা যাবে না। এমনকি বিশ্বের অন্য কোনো দেশের শাসকের মতো চাইলেই তিনি নিজের অনুগত বাহিনী নামিয়ে কোনো সাংবাদিককে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠাতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে তাঁর গদিটি নড়ে উঠতে পারে। কারণ আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বসে থাকবে না। এ কারণে তিনি মঞ্চে হাজির হলেন গোয়েবলসের পরীক্ষিত নীতিটি নিয়ে। নিজের বিরুদ্ধে যেকোনো তথ্য ও মতকেই তিনি ‘গুজব’ অভিধায় উড়িয়ে দিতে চাইছেন। ‘ভুয়া’ কথাটি বারবার বলে তিনি সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে এক ধরনের ক্ষোভ সঞ্চারের প্রয়াস নিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি যে অনেকটাই সফল হয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সংবাদপত্রের অবস্থান অনেক ওপরে। রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিগুলোর একটি হচ্ছে গণমাধ্যম। কারণ এটি সেই শিশুর মতো, যে শাসকের নগ্ন চিত্রটি সাহসের সঙ্গে তুলে ধরতে পারে। সংবাদমাধ্যম বরং ওই শিশুর থেকে আরেকটু অগ্রসর। কারণ রাজাকে ন্যাংটো ঘোষণার আগে সে তথ্য-প্রমাণ হাজির করে। ফলে সম্রাট হওয়ার অভিলাষে যে শাসক হয়েছে, তার কাছে এই সংবাদমাধ্যমকে উপদ্রব বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। ট্রাম্পও তার ব্যতিক্রম নন। শুধু ভুলে গেছেন যে, আগেকার রাজা-মহারাজারাও অগণিত মোসাহেবের ভিড়েও এক বা একাধিক বিদূষক রাখতেন একটু সত্যভাষণ ও সুপরামর্শ শোনার আশায়। রাজ্যসীমা কিংবা প্রতিবেশী রাজ্যের খবরাখবর নিতে নিযুক্ত করতেন ‘খাস লোক (গুপ্তচর) ’। মোসাহেবের ভিড়েও তাঁরা এটা ভুলতেন না যে, সঠিক তথ্য ও সত্যভাষণই কেবল সত্যিকারের বন্ধু হতে পারে। তাঁরা জানতেন যে, ‘বার্তাবাহককে মারতে নেই।’ কিন্তু মুক্তমত, বাক্স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ কথাটি শুধু ভুলেই বসেননি, ঠিক এর বিপরীত কাজ করে যাচ্ছেন, যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অনেক দেশ ও সমাজে। বর্তমান সময়ে কী আমেরিকা, কী আমেরিকার বাইরে ‘গুজব’ শব্দটি এত বেশি উচ্চারিত হচ্ছে যে, খোদ জীবনকেই ‘গুজব’ বলে প্রতিভাত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন সংবাদমাধ্যম যে প্রতিবাদের প্রয়াসটি নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে আশাবাদী করে। সত্যভাষণ থেকে সরে না গিয়ে বরং যূথবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করে এবং আরও সাহসী হয়ে একসঙ্গে সত্য প্রকাশই এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে পারে।
ফজলুল কবির: সাংবাদিক, প্রথম আলো।