ভারতের আসাম রাজ্য এখন রাজনীতির আগুনে জ্বলছে। সেই আগুনের তাপ এখন ছড়িয়ে পড়েছে পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও। গত সোমবার আসামে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) প্রকাশ হওয়ার পর আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো আসামে। ওই নাগরিক নিবন্ধনে বাদ পড়ে যায় ৪০ লাখ বাঙালির নাম। তাঁদের বলা হয় ‘অনুপ্রবেশকারী’। বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী। এটাই মেনে নিতে পারেননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসাম সরকারের এনআরসি ঘোষণার পর খেপে গিয়ে বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত তিনি মানছেন না। মানবেন না। এভাবে বাঙালি বিতাড়ন মানা হবে না। ভারতবর্ষ সব নাগরিকের। এখানে যেকোনো মানুষের যেকোনো রাজ্যে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। এটা মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই তিনি এই সিদ্ধান্ত মানবেন না। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি লড়বেন। যতদূর যেতে হয় যাবেন। তবুও তিনি আসামের বাঙালিদের পাশে থাকবেন।
মমতা এ কথাও বলেন, এই ৪০ লাখ বাঙালি কোথায় যাবেন ? কে নেবে তাঁদের ? কী খাবেন তাঁরা? তারা তো নিজভূমে পরবাসী হয়ে গেলেন! এটা মানা যায় না। তাই দাবি নিয়ে মমতাও নেমে পড়েন রাজনৈতিক ময়দানে। এর ফলে আসামের সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের আনাচকানাচেও।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষও সোচ্চার হয়েছেন। তাঁরা পথে নামেন। দাবি তোলেন আসামের এনআরসি বাতিল করতে হবে। বাঙালিদের বিতাড়ন করা চলবে না। তাঁদের আসামে থাকার অধিকার দিতে হবে। এই দাবিতে অনেকটাই অশান্ত হয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গ। কলকাতার ‘আমরা বাঙালি’ এবং ’বাংলা পক্ষ’ আসামের এনআরসি বাতিলের দাবিতে কলকাতায় আসাম ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তাঁরা এখানে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুল দাহও করেন।
শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া মহাসংঘ রাজ্যব্যাপী সড়ক অবরোধের ডাক দেয়। সেই লক্ষ্যে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ট্রেন ও সড়ক অবরোধ করেন মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষজন। তাঁদের অভিযোগ, আসামের এনআরসিতে বাদ পড়া ৪০ লাখ বাঙালির মধ্যে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ ১৩ থেকে ১৪ লাখ। তাই তাঁরা এই সিদ্ধান্ত মানছেন না। বিক্ষোভ প্রকাশে ট্রেন ও সড়ক অবরোধ করেন তাঁরা। এতে পশ্চিমবঙ্গের জনজীবন বাধাগ্রস্ত হয়।
যদিও এসব দাবি অগ্রাহ্য করে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ নাগরিক নিবন্ধন ঘোষণার দিনই পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে সব অনুপ্রবেশকারী তাড়াতে তাঁরাও আন্দোলনে নামবেন। তিনি বলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবঙ্গেও প্রয়োগ করা হবে এনআরসি। আর পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি প্রয়োগের দাবিতে গতকাল বৃহস্পতিবার কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক থেকে হাজরা মোড় পর্যন্ত এক প্রতিবাদ মিছিল বের করে বিজেপির যুব ও নারী মোর্চা।
এই মিছিল শেষে হাজরা মোড়ে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় বিজেপির নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় দাবি করেন পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি প্রকাশের। তিনি বলেন, এই রাজ্যে ঠাঁই দেওয়া হবে না অনুপ্রবেশকারীদের। তাদের এই রাজ্য থেকে হটিয়ে দেওয়া হবে। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহও এর আগে ইঙ্গিত দেন প্রয়োজনে পশ্চিমবঙ্গেও কার্যকর করা হতে পারে এনআরসি। ফলে এটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
এদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসামের বাদ যাওয়া বাঙালিদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা এবং তাঁদের অবস্থা জানতে গতকাল তৃণমূল কংগ্রেসের ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলকে বাঙালি-অধ্যুষিত শিলচরে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে প্রতিনিধিদলের সদস্যদের একটি নাগরিক কনভেনশনে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। প্রতিনিধিদলে ছিলেন তৃণমূলের ৬ জন সাংসদ, একজন বিধায়ক এবং পশ্চিমবঙ্গের একজন মন্ত্রী। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের পুর ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায়, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, মমতা বালা ঠাকুর, রত্না দে নাগ, নাদিমুল হক, অর্পিতা ঘোষ এবং বিধায়ক মহুয়া মৈত্র।
গতকাল বেলা দুইটার দিকে তৃণমূলের প্রতিনিধিরা শিলচর বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর তাঁদের বিমানবন্দর থেকে বের হতে দেয়নি আসাম পুলিশ। কার্যত বিমানবন্দরেই আটকে রাখা হয় তাঁদের। এ নিয়ে এই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আসাম পুলিশের বাগ্বিতণ্ডার মাঝেই এই প্রতিনিধিদলের ওপর চড়াও হয় আসাম পুলিশ।
পুলিশ হেনস্তা করে এই প্রতিনিধিদলকে। গায়ে হাত দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া যায়। মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া যায়। ফলে এই বাগ্বিতণ্ডার মাঝেই বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে শিলচর থেকে শেষ বিমান ছেড়ে যায়। ফলে এই প্রতিনিধিদল আর ফিরে আসতে পারেনি কলকাতা বা দিল্লিতে। বিমানবন্দরে আটকের পর প্রতিনিধিদলের সদস্যদের রাতেই গ্রেপ্তার করে আসাম পুলিশ। শুধু তা-ই নয়, এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তিনটি মামলাও দায়ের করেছে আসাম পুলিশ। এই মামলা দায়ের হয় উত্তর লখিমপুর, বশিষ্ঠ ও গুয়াহাটি থানায়। আজ গ্রেপ্তার হওয়া তৃণমূল প্রতিনিধিদের ফেরত পাঠানোর কথা রয়েছে।