ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া ইমরান খানকে একসময় পশ্চিমের সাংবাদিক-বিশ্লেষকরা দেখতেন অক্সফোর্ডে পড়া একজন রমণীমোহন প্লেবয় হিসেবে, – যিনি ক্রিকেট খেলার অন্ধিসন্ধি যেমন জানতেন, তেমনি চিনতেন লন্ডনের নাইটক্লাবগুলো।
গার্ডিয়ান পত্রিকার এক সময়কার পাকিস্তান সংবাদদাতা জোনাথন বুন লিখছেন, এমনটাই এখনো মনে করা হয় যে তার রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি তার ব্যক্তিগত জীবনের মতোই উদার হবে।
কিন্তু সত্যি কি তাই হবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, তা বোঝা যাবে আগামি কয়েক মাস বা বছরেই, কারণ এটা স্পষ্ট যে ইমরান খানই হতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের আগামি প্রধানমন্ত্রী।
এই পর্যবেক্ষকরা নানা দিক থেকে হিসেব-নিকেশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান পাকিস্তানে কি পরিবর্তন আনতে চান, বা কতটা তিনি করতে পারবেন।
ইমরান খান কি করতে চান?
ইমরান খান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন পরিবর্তন আনবেন। শিক্ষা আর স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাবেন, তরুণদের জন্য সৃষ্টি করবেন কর্মসংস্থান। এই তরুণরাই মি. খানের প্রধান সমর্থক, এবং পাকিস্তানের জনসংখ্যার তারা ৬৪ শতাংশ।
এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইমরান খানের অসুবিধা হবার কথা নয়। তিনি স্বতন্ত্র সদস্যদের সমর্থন নিয়েই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাবেন, তাকে পিপিপি বা মুসলিম লিগের মতো কোন দলের সাথে অস্বস্তিকর জোট গড়তে হবে না।
তবে ইমরান খানে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ হলো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা।
কারণ তাকে সমালোচক ও প্রতিদ্বন্দ্বীরা দেখেন পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর এস্টাব্লিশমেন্টের একজন ‘প্রক্সি’ বা ক্রীড়নক হিসেবে। এদের অভিযোগ, ইমরান খানকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে সামরিক বাহিনী নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে।
তার বিরুদ্দে আরো অভিযোগ: ইমরান খান গত পাঁচ বছর ধরে নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রচারণা চালিয়ে গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন।
এই পর্যবেক্ষকরা বলেন, পাকিস্তানের আসল সমস্যাটা কোথায় এ নিয়ে ইমরান খানের যে ধারণা – তা একরকম অতি-সরলীকরণ।
তিনি তার সমর্থকদের বলে আসছেন, পাকিস্তানে চাকরি সৃষ্টি করতে হলে এবং সেবা খাতকে উন্নত করতে হলে দেশে পিপিপি আর মুসলিম লিগ(এন)-এর যে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি চলছে তার অবসান ঘটাতে হবে। দুর্নীতিবাজ নেতাদের ধরতে হবে এবং তাদের লুকানো সম্পদ বের করে আনতে তাদের বাধ্য করতে হবে।
কিন্তু একটা প্রকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আর সামরিক-বাহিনী-প্রভাবিত গণতন্ত্রের মোড়ক – এ দুটোর মধ্যে যে পার্থক্য আছে, সামরিক বাহিনী যে নিজের একটি বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য চালাচ্ছে, এবং তারা যে দেশের নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় – এসব নিয়ে ইমরান খানের কোন আগ্রহ দেখা যায় না।
ইমরান খান এমন কোন ইঙ্গিতও দেন নি যে তিনি ধর্মীয় জঙ্গীবাদকে একটা সমস্যা বলে মনে করেন।
সামরিক এস্টাব্লিশমেন্টের সাথে দ্বন্দ্ব
অনেকেই মনে করেন যে কিছুকাল পরই একটা সময় আসবে যখন ইমরান খান দেখতে পাবেন যে তিনি সামরিক এস্টাব্লিশমেন্টের সাথে একটা সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন।
তার দুই পূর্বসূরীর ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটেছে।
এর কারণ সম্পর্কে প্রবীণ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বলেন, যখন ইমরান খান ক্ষমতা গ্রহণ করবেন এবং বৃহৎ পরিসরের ছবিটা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে – তখন তিনি দেখবেন যে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান-অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে এগুতে গেলে তাকে এমন পথ দিয়ে যেতে হবে – যেখানে আগে থেকেই সামরিক বাহিনী আসন গেড়ে বসে আছে।
এই পর্যবেক্ষকরা আরো বলেন, ইমরান খানকে অবশ্যই বিশেষত ভারতের সাথে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব-উত্তেজনা কমাতে হবে। কিন্তু এসব ইস্যুর জন্য প্রধানত পাকিস্তানের নিরাপত্তা এস্টাব্লিশমেন্টকেই দায়ী করা হয়।
ইমরান খানকে পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র এবং বিচার বিভাগকেও সংস্কার করতে হবে। কিন্তু সরকার তার কর্তৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠা করতে গেলে দেখা যাবে যে, যেসব ব্যবসায়িক স্বার্থের কাছে সরকারকে জায়গা ছাড়তে হয়েছে – তার পেছনেও সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা আছে।
সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক অবস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পাকিস্তান এখন ওয়াশিংটনের ত্রাণের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের সম্মুখীন, অথচ তাদের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের প্রধান সাহায্যদাতাই হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসে অর্থায়নসংক্রান্ত একটি নজরদারির তালিকায় পাকিস্তানের নাম উঠেছে। আন্তর্জাতিক অর্থসহায়তা পাবার ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে।
পাকিস্তান এখন গুরুতর আর্থিক সংকটের মধ্যে আছে। তাদের বিপুল বৈদেশিক ঋণ রয়েছে এবং দেশটির মুদ্রার মানও ক্রমাগত কমছে।
কিন্তু যখন পাকিস্তানের নাম সন্ত্রাসে অর্থায়নের তালিকায় উঠেছে, সে সময়ই আন্তর্জাতিক পরোয়ানায় থাকা কিছু জঙ্গী নেতাকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হয়েছে।
শোনা যায় এর পেছনে রয়েছে সামরিক বাহিনী-সমর্থিত একটি নীতি – যার লক্ষ্য হচ্ছে জঙ্গীদেরকে রাজনীতির মূলধারার সাথে সংযুক্ত করা।
দিল্লি বা ওয়াশিংটন কেউই এটা পছন্দ করে নি। এবং নির্বাচনী প্রচারণার সময় ইমরান খান এ বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন – যা তার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী করেন নি।
ইমরান খানের দু’টি বিকল্প
বিশ্লেষকরা বলেন, ইমরান খানকে হয়তো নিম্নোক্ত দুটি পন্থার কোন একটি নিতে হবে।
এক, তিনি হয়তো মুসলিম লিগ (এন) এবং পিপিপি – এই দুই শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে কাজ করার একটা উপায় বের করবেন, কারণ এরা হচ্ছে এমন দুটি বিরোধীদল যাদের ক্ষমতায় থেকে পাকিস্তানের বাস্তবতা দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তবে ইমরান খান দু’ দশক ধরে এই দুটি দলকেই তার প্রধান শত্রু হিসেবে চিত্রিত করেছেন, তাই তার জন্য সেটা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ ইতিমধ্যেই বলেছে, নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ থাকলেও তারা পার্লামেন্ট বয়কট করবে না, এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে ইমরান খানকে দেয়া জনগণের ম্যান্ডেটকে তারা সম্মান দেখাবে।
দ্বিতীয় বিকল্প, পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মধ্যেই তিনি তার তরুণ সমর্থকদের নিয়ে প্রশাসন চালাতে পারেন।
এ ক্ষেত্রে যতদিন ভালোভাবে চলে অন্তত ততদিন তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব করাটা উপভোগ করতে পারবেন।