প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের আশ্রয়দাতা বিএনপির দুর্নীতি ও দুঃশাসনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি দেশ ও জনগণকে কিছু দিতে পারে না। খালেদা জিয়ার সাজা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আদালত তাঁকে জেল দিয়েছেন। আমাদের কাছে এখন মুক্তির দাবি করে লাভ কী, আমরা কিছুই করতে পারব না।’
প্রধানমন্ত্রী শুক্রবার আজ দুপুরে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যক্তিস্বার্থে যে রাজনীতি, সে রাজনীতি কখনো জনগণ ও দেশকে কিছু দিতে পারে না। ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। তাই বিএনপির প্রতি জনগণের কোনো আস্থা নেই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা প্রমাণিত যে বিএনপির ওপর জনগণের কোনো আস্থা ও বিশ্বাস নেই। কারণ তাদের শাসনামলে অর্থাৎ ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে সীমাহীন দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চলছিল।’ তিনি বলেন, যারা অতীতে লুটপাট করেছে, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে আবারও তারা লুটেপুটেই খাবে এবং শুধু নিজেদের ভাগ্য গড়বে।
দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাওসার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই দলের নেতা-কর্মীরা প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
এই দিনটি প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সন্তান এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিন হওয়ায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা মুহুর্মুহু করতালি ও স্লোগানের মাধ্যমে জয়কে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান।
শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে তাঁর সরকারের সাফল্যগাথা ও অর্জন জনগণের কাছে তুলে ধরে আগামী সাধারণ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সংগঠনকে তৃণমূল পর্যায় থেকে আরও সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করতে নেতা-কর্মীদের শৃঙ্খলার সঙ্গে কাজ করতে হবে এবং বিগত সাড়ে নয় বছরে তাঁর সরকারের অর্জনগুলো জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে।’ তাঁর দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘জনগণকে উন্নয়নের কথাগুলো বারবার বলতে হবে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরতে হবে। কারণ, সুখ পেলে জনগণ দুঃখের (অতীত স্মৃতি) কথা ভুলে যায়।’
১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই ধানমন্ডির একটি বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে সপরিবারে বন্দী থাকার সময় জয় জন্মগ্রহণ করেন উল্লেখ করে সেই দিনের কথা অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘২৭ জুলাই দিনটি আমার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। কারণ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে যখন বন্দী ছিলাম, তখনই আমার প্রথম সন্তান জয় জন্মগ্রহণ করে। আজ স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সঙ্গে জয়ের জন্মদিন এক হয়ে গেছে। এ জন্য আমার দোয়া ও আশীর্বাদ সবার জন্য।’
আমেরিকায় তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণের পর হত্যার ষড়যন্ত্র করার জন্যও প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেতাদের অভিযুক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা (বিএনপি) দুর্নীতির মাধ্যমে এত টাকা বানিয়েছিল যে আমেরিকার যে গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের একজন অফিসারকে তারা কিনে ফেলল জয়কে অপহরণ ও হত্যা করার জন্য; যা আবার ধরা পড়ল সেই এফবিআইয়ের হাতে। তিনি বলেন, বিএনপির যে নেতা এই কাজ করেছিল, সে ধরা পড়ার পর তার বিচার হলো এবং সেখানে সেই নেতার শাস্তি হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সেই মামলার রায়ে বেরিয়েছে, খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শফিক রেহমান অর্থ-পরামর্শ দিয়ে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত; এ বিষয়ে এই দুজনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।
বিএনপি-জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের ওপর দেশের সাধারণ মানুষের আর কোনো আস্থা নেই। তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করলেও বায়তুল মোকাররমের ধর্মীয় বইয়ের দোকানে আগুন দিয়ে হাজার হাজার কোরআন শরিফ পুড়িয়েছে। মসজিদে ঢুকে মানুষ হত্যা করেছে। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে কলেজছাত্রী কেউ তাদের নির্যাতন-নৈরাজ্য থেকে রেহাই পায়নি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ১০ বছরের বেশি সময় আদালতে মামলা চলল, বিএনপির এত বাঘা বাঘা আইনজীবীরা প্রমাণে ব্যর্থ হলেন যে খালেদা জিয়া অর্থ আত্মসাৎ করেননি। তিনি বলেন, ‘আদালত তাঁকে জেল দিয়েছেন। কাজেই আমাদের কাছে এখন মুক্তির দাবি করে লাভ কী, আমরা কিছুই করতে পারব না।’
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ তাঁকে জেল দেয়নি। সে রকম হলে তো ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে বিএনপির সন্ত্রাস ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যেত।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় প্রশ্ন করে বলেন, ‘যারা এতিমের অর্থের লোভ সামলাতে পারে না, তারা কীভাবে দেশ চালাবে।’
প্রধানমন্ত্রী ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর ছয় বছর প্রবাসে জীবনে কাটাতে বাধ্য হয়ে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দেশে ফেরার স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ‘বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে দেশে ফিরেছি, কারণ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ভাত-ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য।’ তিনি এ সময় দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছি, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি। বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি হচ্ছে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৭ দশমিক ৭৮ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, আমাদের দারিদ্র্যের হার কমিয়েছি।’
২০০৮ সালে জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে তাঁর সরকার এই বর্তমান সময় পর্যন্ত মেয়াদে সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের হারানো সম্মান ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আজ কারও কাছে হাত পেতে আমাদের চলতে হয় না। আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির শতকরা ৯০ ভাগ আমাদের নিজস্ব অর্থায়ন থেকে বাস্তবায়নের সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি। আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য নিয়ে তাঁর সরকার যাত্রা শুরু করেছিল, সেই লক্ষ্যে আজকের বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত হয়েছে। তিনি সবাইকে একযোগে কাজ করে দারিদ্র্যমুক্ত, মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত ও উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলারও আহ্বান জানান।
২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার তাঁর দৃঢ়প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা এমন বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রতিটি গ্রাম হবে শহর। গ্রামের জনগণ নগরের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবে। যেখানে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করতে আগামী ২০২১-২০৪১ মেয়াদী নতুন পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে বলে জানান শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিন উপলক্ষে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে কেক কাটেন প্রধানমন্ত্রী।