যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণ বাংলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘মৃত্যু ভয় পাই না। মৃত্যুর আগে মরতে রাজি না।’
আজ শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া গণসংবর্ধনায় ভাষণ দিতে গিয়ে তাঁর এই দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা।
মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, গ্লোবাল উইমেন্স লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড, কলকাতা থেকে ডি-লিট উপাধি পাওয়াসহ নানা সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আজ গণসংবর্ধনা দেয় আওয়ামী লীগ।
বিকেল ৪টা ৪২ মিনিটে ভাষণ দিতে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তিনি লোকে লোকারণ্য উদ্যানে গিয়ে পৌঁছান। শেখ হাসিনা মঞ্চে উঠতেই স্লোগানে আর হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে এই ঐতিহাসিক উদ্যান। আধা ঘণ্টার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মানপত্র পাঠ করেন। এই মানপত্র তিনি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন।
স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন, বাংলাদেশের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন, স্বাধীনতার দেশের মানুষ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য ত্যাগের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যা কিছু অর্জন করেছে, মহান ত্যাগ করেই অর্জন করেছে।
ভাষণের শুরুতেই তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনার জবাব প্রধানমন্ত্রী দেন এভাবে, ‘আমি জনগণের সেবক। জনগণ কী পেল, সেটাই আমার বড় চাওয়া। আমার সংবর্ধনার প্রয়োজন নেই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেখতে চাই। এটাই বড় চাওয়া।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার জীবনের লক্ষ্য একটিই, বাংলার মানুষের উন্নয়ন। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষের ভাগ্য যেদিন গড়তে পারব, সেদিনই নিজেকে সফল মনে করব।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি তাঁর দল আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ইতিহাসও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। এই দলটির প্রতীক নৌকার বিজয়ের সঙ্গে দেশের মানুষের বিজয় ও অর্জন যে সম্পর্কিত, সে কথাই তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। তিনি বলেন, দেশের একটি শ্রেণি আছে, যাদের কথা, নৌকা ঠেকাতে হবে। কেন নৌকা ঠেকাতে হবে? নৌকার অপরাধ কী?
শেখ হাসিনা বলেন, এ দেশের মানুষ মায়ের ভাষায় কথা বলার সুযোগ পেয়েছে নৌকার জন্য। স্বাধীন দেশ পেয়েছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে নৌকায় ভোট দিয়ে। দেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে নৌকার জন্য, পরমাণু যুগে প্রবেশ
নৌকার হাত ধরে, স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে নৌকার কারণেই।
শেখ হাসিনা বলেন, সামরিক সরকারদের উচ্ছিষ্টভোগীরা নৌকা ঠেকাতে চায়।
নিজের রাজনৈতিক জীবনের অনেক কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা তাঁর আজকের বক্তৃতায়। তিনি বলেন, ‘অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছে। তবে সব সময় নিজের আদর্শে অবিচল থেকেছি। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে—এ প্রত্যয় সব সময় ছিল।’
১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দেন শেখ হাসিনা। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথমবার ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কথা, পার্বত্য চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার রোধকারী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের কথা বলেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০১-এ ক্ষমতায় আসতে পারিনি। নীতির সঙ্গে আপস করিনি বলেই ক্ষমতায় আসতে পারিনি।’ গ্যাস বিক্রির আপস করার প্রস্তাব ছিল, কিন্তু তা না করাতেই তিনি ক্ষমতায় আসতে পারেননি বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা বিএনপি-জামায়াতের সরকার দেশে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মানি লন্ডারিং করে। বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদে দেশের মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়ায় তাঁর দল আবার ক্ষমতায় আসে।
বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে অগ্নিসন্ত্রাস হয় বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং রায়ের ফলে বাংলাদেশ কলুষমুক্ত হয়েছে। এগিয়ে যাওয়ার পথ পেয়েছে। উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
দুই মেয়াদের সরকারে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘৬৮ বছরের সমস্যা ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেছি। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমার সমস্যা সমাধান করেছি। আজ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশে ৫৩তম দেশ হিসেবে যোগ দিয়েছে পরমাণু ক্লাবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছি। এর মধ্য দিয়ে স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।’
অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নানা অর্জনের কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বিশ্বমন্দার প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে দিইনি। প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৭ ভাগে উন্নীত হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৬ ভাগে নামিয়ে আনা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, দেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করলে কারও কারও আঁতে ঘা লাগে।
শেখ হাসিনার ভাষণে আসে জঙ্গিবাদ ও মাদক প্রসঙ্গও। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের যে বীজ বিএনপি বপন করেছিল, তা থেকে মুক্ত করতে চেষ্টা চলছে। মাদককে দেশ ও সমাজের জন্য ভয়াবহ বিষ হিসেবে তুলনা করে শেখ হাসিনা বলেন, মাদকের প্রভাব থেকে সমাজ ও দেশকে মুক্ত করতে হবে।
দুস্থ ও প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নে তাঁর সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় ৪০ লাখ বয়স্ক মানুষ, ১২ লাখ বিধবা, ১০ লাখ প্রতিবন্ধীকে প্রতি মাসে ৭০০ করে টাকা দেওয়া হচ্ছে।
সরকার ২ কোটি ৪ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেয় বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, অনগ্রসর সব শ্রেণি ও পেশার মানুষকে যে ভাতা দেওয়া হয়, তা মুঠোফোনের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণের শেষ দিকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি বরদাশত করব না। এগিয়ে চলার পথ যেন অব্যাহত রাখতে পারি, সে জন্য দেশের মানুষের দোয়া চাই।’
প্রধানমন্ত্রীর আজকের এই সংবর্ধনা উপলক্ষে আজ সকাল থেকেই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসমাবেশ হতে থাকে। ছোট ছোট মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশে অবস্থান শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী আসার বেশ আগেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে সংবর্ধনাস্থলে পৌঁছে গেছেন। বেলা দুইটায় সংবর্ধনার মূল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বেলা ১১টার পর থেকে মিছিল আসা শুরু হয়। পিকআপ নিয়ে মিছিল করে নেতা-কর্মীরা ঢুকে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সকাল থেকে কোনো বাস ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কাঁটাবন দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সমাবেশে যেসব গাড়ি আসে, সেগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয় মল চত্বরে। বাংলামোটর এলাকায় ডাইভারশন দেওয়ার কথা থাকলেও সকালে রাস্তায় যানজট কম থাকায় সেখানে ডাইভারশন দেওয়া হয়নি।
দুপুর সাড়ে ১২টার পর থেকেই সংবর্ধনাস্থলের আশপাশের প্রায় সব সড়কে ডাইভারশন দেওয়া হয়। বেলা একটার পর থেকে ভিআইপি রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, পল্টন, মৎস্য ভবন এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় যানজট দেখা দেয়।
শাহবাগ এলাকায় ছোট ছোট মিছিলে ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড বহন করতে দেখা গেছে। এসব ব্যানারে শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে নানা অর্জনের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এ সমাবেশ উপলক্ষে ঢাকা মহানগর ও আশপাশের এলাকা থেকে পরিবহনযোগে ও হেঁটে অসংখ্য নেতা-কর্মী, বিশিষ্ট ব্যক্তি, পেশাজীবী ও সাধারণ জনগণ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়। এই সমাবেশে উপলক্ষে ব্যাপক শোভাযাত্রা করেছে আওয়ামী লীগ।