- ৪০ পিলারের মধ্যে ২২টিতে ৭টি করে পাইল।
- ৯টি পিলারের নতুন নকশা ঠিকাদারদের কাছে, বাকি ১৩টি এ মাসেই দেবে।
- ২০১৯ সালেই সম্পূর্ণ পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পিলার সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয়ে গেছে। নদীর মধ্যে থাকা ৪০টি পিলারের মধ্যে ২২টির নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। পরিবর্তিত নকশা অনুযায়ী বেশ কয়েকটি পিলারের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলীরা বলছেন, ‘তাঁদের এখন টেনশনই নেই।’ আর প্রকল্পের বিশেষজ্ঞরা জানান, ২০১৯ সালেই পুরো পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করা যাবে।
প্রকৌশলীরা জানান, সেতুর ১৪টি পিলারের নকশা অনুযায়ী কাজ করা যাচ্ছিল না। এর সঙ্গে আটটি পিলারের সাতটি করে পাইল বসানোর সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে ২২টি পিলারের নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। বাকি ১৮টি পিলারে আগের নকশা অনুসারে ছয়টি করে পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। নকশার সব সমস্যার সমাধান হওয়ায় ২০১৯ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করা সম্ভব হবে।
২০১৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ৫৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। ৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ পরিদর্শনের সময় সচিব এ তথ্য জানান। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মূল সেতুর ৫৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ২২টি পিলারের মধ্যে বেশির ভাগ পিলারের নতুন নকশা গত ১৯ মার্চ মূল সেতুর ঠিকাদার চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির কাছে পাঠানো হয়েছে। বাকি নকশা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। সেগুলো দ্রুতই তাদের কাছে পাঠানো হবে। এখন আর কোনো বাধা নেই। ২০১৯ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ হয়ে যাবে। তবে নদীশাসন সম্পন্ন হতে আরও কিছুটা দেরি হতে পারে।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, পাইলের সংখ্যা বাড়লেও এর দৈর্ঘ্য কমে গেছে। তাই পিলারে পাইলের সংখ্যা বাড়ানো হলেও পদ্মা সেতুর ব্যয়বৃদ্ধি নাও হতে পারে। নকশার সমাধান হওয়ায় সেতুর অবশিষ্ট কাজ ২০১৯ সালের মধ্যে করা যাবে।
নদীর তলদেশের গভীরে নরম মাটির স্তর থাকায় হ্যামার দিয়ে পাইল বসাতে গিয়ে ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ২৬, ২৭, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৫ নম্বর পিলারের কাজে সমস্যা দেখা যায়। তাই এই ১৪টি পিলারের নকশা চূড়ান্ত করা যাচ্ছিল না। সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করে ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাউই (COWI) ইউকে লিমিটেড। কাউই ইউকের বিশেষজ্ঞরা মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আরও কয়েকটি বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের কয়েক দফা বৈঠক হয়। কাদামাটির পরই শক্ত মাটি না পাওয়ায় পদ্মা সেতুর ২২টি পিলারে একটি করে পাইলের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এসব খুঁটিতে ছয়টি পাইল অন্যান্য পিলারের মতোই রেকিং বা কিছুটা বাঁকা করে বসানো হবে। এই ছয়টি পাইলের মধ্যে ৭ নম্বর পিলার ভার্টিক্যাল বা সরাসরি সোজাভাবে বসানো হবে। এ জন্য পদ্মা সেতুতে মোট পিলারের সংখ্যা ২৪০ থেকে বেড়ে হবে ২৬২টি।
তবে ২২টি পিলারে পাইলের সংখ্যা বাড়লেও এগুলোর দৈর্ঘ্য কম হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, আগের ১৮টি পিলারের পাইলগুলো ১২৮ মিটার গভীর পর্যন্ত বসানো হয়েছে। পরিবর্তিত নকশায় ২২টি পিলারের দৈর্ঘ্য অবস্থান অনুযায়ী কম হবে। এসব পিলারের নম্বর হলো ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৫, ১৯, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ৩৬। এর মধ্যে ১৫, ১৯, ২৪ ও ২৫ নম্বর পিলারের পাইলগুলোর দৈর্ঘ্য হবে ৯৮ মিটার। ৬, ৭, ৮, ১০ ও ১১ নম্বর পিলারের পাইলগুলো হবে ১০৪ মিটার দৈর্ঘ্য। ২৬, ২৭, ৩০, ৩১ ও ৩২ নম্বর পিলারের পাইলগুলো দৈর্ঘ্য হবে ১০৬ মিটার। ২৯ ও ৩৫ নম্বর পিলারের পাইলগুলো দৈর্ঘ্য হবে ১১১ মিটার। ১২ ও ২৮ নম্বর পিলারের পাইলগুলো হবে ১১২ মিটার দৈর্ঘ্যের। ৯, ৩৩, ৩৪ ও ৩৬ নম্বর পিলারের পাইলগুলো হবে ১১৪ মিটার দৈর্ঘ্যের। নদীর তলদেশের মাটির স্তর ছাড়াও ভূমিকম্প, সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন ও যানবাহনের চাপ, বাতাসের চাপ ও নৌযান চলাচলের চাপ বিবেচনা করে পাইলগুলোর গভীরতা ও দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর প্রকল্পের এক ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী জানান, ২২টি পিলারের মধ্যে ১৫, ১৯, ২৪, ২৫, ২৮, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ৩৬ নম্বর পিলারের নকশা মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির কাছ পাঠানো হয়েছে। আগের ১৮টিসহ এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৭টি পিলারের চূড়ান্ত নকশা দেওয়া হয়েছে। নতুন নকশায় নয়টি পিলারের পাইল বসানোর কাজ চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন শুরু করে দিয়েছে। বাকি ১৩টি পিলারের নকশা দ্রুত তাদের দেওয়া হবে।
দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতু হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটি প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। পিলারের ওপর ইস্পাতের যে স্প্যান বসানো হবে, এর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। পুরো সেতুতে মোট পিলার হবে ৪২টি। এর মধ্যে নদীতে থাকবে ৪০টি পিলার। এক পিলার থেকে আরেক পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার। এই দূরত্বের লম্বা ইস্পাতের কাঠামো বা স্প্যান জোড়া দিয়েই সেতু নির্মিত হবে। ৪২টি পিলারের ওপর এ রকম ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। স্প্যানের অংশগুলো চীন থেকে তৈরি করে সমুদ্রপথে জাহাজে করে আনা হয় বাংলাদেশে। স্প্যানের অংশ সংযুক্ত করা হয় মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে। এর মধ্যে ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিলারে তিনটি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর ৪৫০ মিটার এখন দৃশ্যমান হয়েছে। এ ছাড়া ২৬২টি পাইলের মধ্যে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ১৬২টি পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ৪০ ও ৪১ নম্বর পিলারের ওপর আরও একটি স্প্যান এপ্রিল মাসের শেষ দিকে বসানোর আশা করছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। জাজিরায় একেবারে শেষ ৪২ নম্বর পিলারের নির্মাণকাজও শেষের পথে। এ ছাড়া মাওয়া প্রান্তে ২ নম্বর পিলারও দৃশ্যমান হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করেছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও আট হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ফলে পদ্মা সেতুর ব্যয় দাঁড়িয়েছে সব মিলিয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।