১৯৭১ সালের মার্চ মাসে একটি দরিদ্র ভূখণ্ডের আপামর জনসাধারণ বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সেই সংগ্রামের মাসে বাংলাদেশের উন্নয়ন ইতিহাসে যুক্ত হলো অনন্য এক অর্জন। স্বাধীনতা লাভের ৪৭ বছর পর জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) শ্রেণি থেকে বের হওয়ার যোগ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর ফলে জাতিসংঘের বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশের পথে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটি (সিডিপি) গতকাল বাংলাদেশের এ যোগ্যতা নিশ্চিত করেছে। আজ জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনকে এ বিষয়ে চিঠি দেবে সিডিপি। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকালে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনের একটি সূত্র এ খবর নিশ্চিত করে।
বিকেলে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে এলডিসি থেকে উত্তরণ বিষয়ে এক ঘোষণায় বাংলাদেশের এ যোগ্যতা অর্জনের তথ্য লক্ষ্য করা যায়। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশ হবে বাংলাদেশ। নতুন এ অভিযাত্রায় সুযোগের পাশাপাশি অনেক চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি হবে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাণিজ্য ও বৈদেশিক ঋণে যেসব বাড়তি সুযোগ রয়েছে, তার সবকিছু থাকবে না। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার কার্যকর বাস্তবায়ন হলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মানুষের জীবনমানের ক্রমাগত উন্নতি করা সম্ভব।
এর আগে বহু দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্য বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এ তিনটি সূচকেই যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যা এর আগে অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে ঘটেনি। বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার ও লাওস এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। ভুটান, সাও তোমে ও প্রিনসিপে এবং সলোমন দ্বীপপুঞ্জ দ্বিতীয়বারের মতো যোগ্যতা অর্জন করায় তাদের এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করেছে সিডিপি।
প্রতি তিন বছর অন্তর সিডিপি এলডিসি দেশগুলোর অবস্থা পর্যালোচনা করে। বাংলাদেশ ২০২১ সালে দ্বিতীয়বার পর্যালোচনায় যোগ্য হলে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করবে ওই কমিটি। এর তিন বছর পর অর্থাৎ ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছাবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয়ের বিবেচনায় এ শ্রেণীকরণ করে বিশ্বব্যাংক। জাতিসংঘ তার সদস্য দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি), উন্নয়নশীল এবং উন্নত- এ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করে। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সাল থেকে এলডিসি।
মতামত জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ২০২১ সালে দ্বিতীয় পর্যালোচনা করবে সিডিপি। ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এ উত্তরণকে অনুমোদন দেবে। বাংলাদেশের অগ্রগতি এখন যেভাবে আছে, তার কোনো বড় ধরনের ব্যত্যয় না ঘটলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছাবে।
উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সুবিধা জানতে চাইলে জাহিদ হোসেন বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় মর্যাদার। বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে তার একটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। বাংলাদেশকে সবাই তখন আলাদাভাবে বিচার করবে। আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও সম্ভাবনা রয়েছে। চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হলে বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে বাণিজ্যে যে অগ্রাধিকার পায় তার সবটুকু পাবে না। আবার বৈদেশিক অনুদান, কম সুদের ঋণও কমে আসবে। বাংলাদেশ তার সক্ষমতা দিয়ে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে।
যেসব মানদণ্ড পর্যালোচনা হলো :জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি কমিটি (সিডিপি) গত ১২ থেকে ১৬ মার্চ এলডিসি দেশগুলোর ওপর ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা বৈঠকে বসে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এ তিনটি সূচকের দুটিতে উত্তীর্ণ হলে কোনো দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। তবে শুধু মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতেও কোনো দেশ যোগ্য হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মাথাপিছু আয়ের যে মানদণ্ড রয়েছে ওই দেশের মাথাপিছু আয় তার দ্বিগুণ হতে হবে।
২০১৮ সালের পর্যালোচনায় এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা হিসেবে মাথাপিছু আয়ের মানদণ্ড ১২৩০ ডলার। বিশ্বব্যাংক প্রণীত অ্যাটলাস পদ্ধতির হিসাবে গত তিন বছরের গড় মাথাপিছু আয় ওই পরিমাণ হতে হবে। জানা গেছে, ওই পদ্ধতিতে গত তিন বছরে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১২৭২ ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে মাথাপিছু আয় আরও বেশি। বিবিএসের হিসাবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ১৬০৫ ডলার।
এবারের পর্যালোচনায় মানবসম্পদ সূচকে যোগ্যতা নিরূপণের জন্য স্কোর ধরা হয় ৬৬ বা তার বেশি। বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৮। মানবসম্পদ সূচকে পাঁচটি বিষয়ের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নেয় সিডিপি। এগুলো হলো- পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের মৃত্যুহার, মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির হার, অপুষ্টিতে থাকা জনসংখ্যার হার, বয়স্কদের সাক্ষরতার হার এবং মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার। শেষেরটি ২০১৮ সালের পর্যালোচনায় যুক্ত হয়েছে।
অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে যোগ্য হওয়ার নির্ধারিত স্কোর ছিল ৩২ বা তার কম। বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়িয়েছে ২৫। এ সূচকে আটটি বিষয় বিবেচনায় নেয় সিডিপি। এগুলো হলো- জনসংখ্যা, উপকূলীয় এলাকায় জনসংখ্যার অনুপাত, দুর্গম এলাকা, পণ্য ও সেবা রফতানিতে অস্থিতিশীলতা, রফতানি পণ্য কেন্দ্রীভূত হওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার জনসংখ্যা, জিডিপিতে কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের অংশ এবং কৃষি উৎপাদনে অস্থিতিশীলতা।
যেসব চ্যালেঞ্জ সামনে :গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যারা এর আগে এলডিসি থেকে বের হয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। প্রথমত, সুশাসন নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়ন ও রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হতে হবে। উন্নতি করতে হবে জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষায়। বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। উচ্চ মূল্য সংযোজন হয় এমন শিল্পের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় রেখে বৈদেশিক ঋণের ব্যবহার করতে হবে।
বাংলাদেশের এ অর্জন নিয়ে খুব বেশি আত্মতুষ্টিতে না ভুগে সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনেক কম সুদে এবং অপেক্ষাকৃত সহজ শর্তে ঋণ পায়। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পক্ষ থেকে এ ধরনের ঋণ দেয় এর অঙ্গ সংস্থা আইডিএ। আরও কয়েক বছর পর হয়তো বাংলাদেশ আইডিএ ঋণ পাবে না। বাংলাদেশকে এ বিষয়টি মাথায় রেখে এগোতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হানও মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি অনেক ইতিবাচক খবর। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে। আরও বেশি হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথ সুগম হবে। তিনি বলেন, উত্তরণের সব পর্যায়েই কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। এগুলো মোকাবেলার প্রস্ততি নিতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটার তিন বছর পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বর্তমান জিএসপি সুবিধা থাকবে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পায়। বাংলাদেশকে তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এলডিসি না থাকলে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশেও অনেক ক্ষেত্রে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পাবে না। এ জন্য বিমসটেক, বিবিআইএনের মতো আঞ্চলিক উদ্যোগের সুবিধা কীভাবে কার্যকরভাবে নেওয়া যায় তার প্রস্তুতি থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। কেননা শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা না থাকলে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে ২০২৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপেীয় ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ উদ্যোগের আওতায় পণ্য রফতানিতে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা পাবে। বাংলাদেশ মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার, পরিবেশ ও সুশাসন বিষয়ে ইইউর নিয়ম-কানুনের শর্ত পূরণ করলে জিএসপি প্লাস নামে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পাবে।