ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাত কলেজের অধিভুক্তি নিয়ে সম্প্রতি ফের উত্তপ্ত দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং আন্দোলন দমাতে প্রশাসনের ভূমিকা আর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা। কলেজগুলোর অধিভুক্তকরণ, প্রশাসনের করণীয় এবং ছাত্রলীগের হামলার প্রেক্ষিতে এর পক্ষ থেকে মতামত জানতে চাওয়া হয় বিশিষ্টজনদের কাছে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটলো, তা দুঃখজনক। অন্য কোনো কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিতে চাইলে, তাতে শিক্ষার্থীদের অভিমত নেয়া আবশ্যক বলে মনে করি। তা হয়নি সাতটি কলেজ অধিভুক্তকরণের ক্ষেত্রে।’ আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা দেয়ার অধিকার অন্য কোনো সংগঠনের নেই। প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন না, এগিয়েও এলেন না। আন্দোলন দমাতে অন্য একটি ছাত্র সংগঠনের সহায়তা নিলেন। এটি কিভাবে সম্ভব? কেন এ নির্ভরতা? এটি সবার জন্য বড় লজ্জার!’
সাত কলেজের অধিভুক্তি অপরিকল্পিত বলে মত দিয়েছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কেন অধিভুক্তকরণ করতে হলো, কী স্বার্থ ছিল, এ বিষয়গুলো আলোচনার ব্যাপার এ কারণে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীরা চাপে পড়েছে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। এতসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে এমনিতেই নানা চাপে থাকতে হয়। শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণের ঘাটতি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকেই।’
অধিভুক্ত না করার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে, তা এসব প্রশ্নে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করেন এ শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘প্রশাসনও অধিভুক্তকরণ নিয়ে ভুল পরিকল্পনার কথা স্বীকার করছে। অথচ শিক্ষার্থীদের দাবি মানল না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা একটি ন্যায্য দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে, কিন্তু প্রশাসন তা আমলেই নিল না। এ নিয়ে বিতর্কিত ভূমিকা রাখল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একেবারে নিম্নশ্রেণির আচরণ করল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল। আন্দোলনকারীদের পুলিশে দেয়া হলো। বিশেষ একটি ছাত্র সংগঠন দিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করা হলো। ’শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ আচরণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করার কথা নয়। সবার আগে শিক্ষার্থী এবং তাদের অধিকার বলে মত দেন তিনি।
শিক্ষায় অপশক্তি ভর করেছে এমনটি উল্লেখ করে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েই তো অসন্তোষ প্রকাশ করতে হচ্ছে। শিক্ষার নামে কী হচ্ছে এসব! শিক্ষার সবই তো এখন গুলিয়ে যাচ্ছে। গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে শিক্ষার সব কাঠামো। এভাবে একটি শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড়ায়!’ এই যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাতটি কলেজকে আনা হলো, কেন? কী দরকার ছিল, তার ব্যাখ্যা কি? এমন প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সরকার শিক্ষা নিয়ে সঠিক জায়গায় দাঁড়াতে পারছে না। অস্থিরতা রয়েই যাচ্ছে। সরকারের ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে পারছে না বলেই হয়তো সাতটি কলেজ আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসতে চাইছে। কিন্তু কীভাবে আসবে, কী মান হবে তার তো কিছুই তৈরি হয়নি। লাখো শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে তো এভাবে ছিনিমিনি খেলা যায় না।’
এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘেরাও হতেই পারেন, অবরুদ্ধ হতে পারেন। শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার আদায়ে এতটুকু করতেই পারে। আমরাও দেখেছি। কিন্তু তাতে কোনো অঘটন ঘটে না। যদি না উসকানি দেয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘেরাও হলে তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা আছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আছে, প্রক্টরিয়াল বডি আছে। ছাত্রলীগকে আসতে হলো কেন? কে ডাকলো ছাত্রলীগকে? তার মানে ছাত্রলীগ যখন ভিসিকে উদ্ধারের দায়িত্ব নেয়, তখন ভিসি ছাত্রলীগের হয়ে যান। তিনি আর সাধারণের থাকতে পারেন না। চরম দলবাজি করতে হয় তখন। ঠিক ফুটবলের মতো। ছাত্রলীগ তাতে হাওয়া দিয়ে লাথি মারে। কিছুই আর করার থাকে না।’