‘মাঘের শীতে বাঘে কাঁপে’—এই প্রবাদের সত্যতা মিলেছে এবার। পঞ্জিকায় মাঘ এসেছে রোববার। পাতা উল্টালেও পারদের নড়নচড়ন নেই। পৌষে যা ছিল, মাঘেও তা-ই। উত্তর-পশ্চিম থেকে ঘণ্টায় ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার বেগে বইছে কনকনে হাওয়া। তাতে কাঁপছে উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণবঙ্গ, মধ্যাঞ্চল, পাহাড়-ঘাট। সর্বত্রই এখন প্রতীক্ষার প্রহর—উষ্ণতার। আগামী তিন থেকে চার দিন এ অবস্থাই থাকবে—পূর্বাভাস আবহাওয়া অধিদপ্তরের।
ক’মাস আগেও রাজধানীতে ছিল মরুর রোদ-হাওয়া! কিন্তু রোববার মেঘ-কুয়াশায় দার্জিলিং বলে ভুল হয় ঢাকার আকাশকে। সোয়েটার, মাফলার, কান-টুপি, দস্তানা পরে নগরবাসী যেভাবে জবুথবু হয়ে পথে বেরুচ্ছে, তার সঙ্গে ঢাকার চেনা চেহারার মিল কোথায়! ঢাকায় শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শেষ কবে কুয়াশা ছাড়ার সুযোগ হয়েছিল, তা বোধ হয় মনেই নেই নগরবাসীর। এবারের শীতকাল সে সুযোগ এনে দিয়ে ‘শীতবিলাসীদের’ সুখ দিলেও, ছিন্নমূল ও ভাসমান মানুষ আছেন চরম দুর্ভোগে!
তার চেয়েও খারাপ অবস্থা উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে। কাঠ-লাকড়ির দুর্মূল্য; তাই যা পাচ্ছেন তাই পুড়িয়ে আগুনে হাত মেলে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন গ্রামের মানুষ। এবারের শীতে মৃতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত। আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধের সংখ্যাও কম নয়। যারা দিনে এনে দিনে খান, তাদের অবস্থা শোচনীয়। শীতের কারণে কৃষিকাজ প্রায় স্থবির। ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে ধানের বীজতলা ও আলু।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় শীতের বিড়ম্বনা চলছে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে। ঘন কুয়াশায় প্রায় প্রতিদিনই আট থেকে ১০ ঘণ্টা নদীতে ফেরি পারাপার বন্ধ থাকছে। রোববার ভোর সাড়ে ৪টা থেকে ছয় ঘণ্টা বন্ধ ছিল দৌলতদিয়া-আরিচা নৌরুট। শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে সকাল ৬টা থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টা ফেরি চলেনি। হাজার হাজার যাত্রী ঘাটে আটকা পড়েন। কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয় দুই ঘাটে।
ঘন কুয়াশায় দূরপাল্লার বাস চলছে ধীর গতিতে। দিনের বেলায় হেডলাইট জ্বালিয়ে পথ চলতে হচ্ছে। বিশেষত উত্তরবঙ্গের সড়কগুলোতে ভরদুপুরে লাইট ছাড়া চলা দায়। এ কারণে বাড়তি সময় লাগছে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে। যোগাযোগে বাধার অজুহাতে সবজির দাম চড়েছে ঢাকার বাজারে।
উড়োজাহাজও কুয়াশায় ঠিক-ঠিক চলতে পারছে না। আগের দিনগুলোর মতো রোববারও বিমান চলাচল ব্যাহত হয়। ভোর ৫টা থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টা বিমান অবতরণ-উড্ডয়ন বন্ধ ছিল ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে। তিনটি উড়োজাহাজ ঢাকায় অবতরণ করতে না পেরে কলকাতায় নামে।
গত ৩ জানুয়ারি থেকে উত্তরবঙ্গে বইছে শৈত্যপ্রবাহ। পরের চার দিনে পারদ আরও নেমেছে। গত ৮ জানুয়ারি ইতিহাসের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল পঞ্চগড়ে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি। উত্তরে তাপমাত্রা গত সাত দিনে কিছুটা চড়লেও, শীতের দাপট কমেনি। রোববারও উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ ডিগ্রির নিচে।
শৈত্যপ্রবাহ উত্তরবঙ্গ ছাড়িয়ে দক্ষিণে ছড়িয়েছে গত সপ্তাহে। রোববার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল যশোরে—৭ দশমিক ২ ডিগ্রি। ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৮ ডিগ্রি। অন্যান্য জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও ১০-এর আশেপাশে। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে আরও কম।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে, ১০ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা নামানো বাতাসকেই শৈত্যপ্রবাহ বলে। আর ৬-এর নিচে নামলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। এ হিসেবে দেশের কোথাও রোববার তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ছিল না। কিন্তু ঘণ্টায় পাঁচ থেকে ১০ কিলোমিটার গতির হিমেল হাওয়ায় শীতের তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে বলে জানান আবহাওয়াবিদ শামীম হাসান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ওপর বায়ুমণ্ডলের ‘জেড প্রবাহ’ নিচু হয়ে বইছে। এতে তাপমাত্রার খুব বেশি পতন না হলেও, ঠাণ্ডা বেশি অনুভূত হচ্ছে।’
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ অঞ্চলসহ রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে বইছে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। সারাদেশে সোমবার রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। কোথাও তা দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।