আসন্ন বিশ্ব ইজতেমায় ভারতের নেজামুদ্দিনের মুরব্বি মাওলানা সাদ কান্ধলভির অংশগ্রহণ নিয়ে তাবলিগ জামাতের দুটি গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। একটি পক্ষ যেকোনো মূল্যে তাকে বাংলাদেশে আনার পক্ষে। আরেকটি পক্ষ আনার বিরোধী। এ নিয়ে বিশ্ব ইজতেমায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে সঙ্কট নিরসনে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। দু’গ্রুপের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দফতরের কর্তাব্যক্তিরা।
আগামী ১২ জানুয়ারি শুক্রবার থেকে টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমার প্রথমপর্ব শুরু হবে। ১৪ জানুয়ারি হবে আখেরি মুনাজাত। এরপর ১৯ তারিখ থেকে ইজতেমার দ্বিতীয়পর্ব শুরু হয়ে ২১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে আখেরি মুনাজাত। ইজতেমায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাবলিগের সাথীরা অংশ নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলার কয়েক লাখ মুসল্লি ইজতেমায় শরিক হন। ইজতেমায় তাবলিগের প্রতিষ্ঠা স্থান ভারতের নেজামুদ্দিনের মুরব্বি ফয়সাল (আমির) প্রধান অতিথি হিসেবে আলোচনা করে থাকেন।
তবে ২০১৫ সালে ভারতে তাবলিগের মুরব্বিদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াসের বংশধর এবং ভারতের নেজামুদ্দিনের শূরা সদস্য মাওলানা সাদ কান্ধলভি নিজেকে তাবলিগের আমির হিসেবে ঘোষণা দিলে সেখানকার শূরা সদস্য মাওলানা ইবরাহীম দেওলা, মাওলানা আহমাদ লাটসহ কয়েকজন বিরোধিতা করেন। পরে তারা ওই মারকাজ থেকে বেরিয়ে যান। তাবলিগের কেন্দ্রে এ বিভক্তি অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে তাবলিগ জামায়াতের কেন্দ্র রাজধানীর কাকরাইল মারকাজ মসজিদের শূরা সদস্যদের মধ্যেও মতপার্থক্য দেখা দেয়। কাকরাইল মসজিদে বর্তমানে মাওলানা সাদের সমর্থক হিসেবে প্রকৌশলী সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামসহ কয়েকজন শূরা সদস্য রয়েছেন। একইভাবে মাওলানা যোবায়ের আহমেদসহ বেশ কয়েকজন শূরা সদস্য মাওলানা সাদের বিরোধিতা করছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, মাওলানা সাদ কান্ধলভি ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য প্রচার করছেন। যাতে তাবলিগের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
ভারতের কওমি মাদরাসার সূতিকাগার দেওবন্দ মাদরাসার উদ্যোগে তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এ দেশের কওমি মাদরাসার আলেমরাও তাবলিগের সাথে জড়িত। তারা মাওলানা সাদের বক্তব্যকে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী মনে করছেন। এ জন্য তারা গত বছরেও বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সাদের আগমন ঠেকানোর চেষ্টা করেন। প্রথম দিকে কিছুটা সফল হলেও পরে মাওলানা সাদ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে চলে আসেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জোড় ইজতেমায়ও মাওলানা সাদের প্রতিনিধিদের ইজতেমা মাঠে ঢুকতে দেননি এ দেশের আলেমরা। তারা মনে করেন, মাওলানা সাদ যেসব কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে তাবলিগের অনুসারীরা বিভ্রান্ত হতে পারে। এ জন্যই তারা আসন্ন বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সাদের আগমন ঠেকাতে অনেক দিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে তারা গত ২৯ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে বসেন।
ওই বৈঠকে কাকরাইল মারকাজের শূরা সদস্য ও কওমি আলেমরা অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে মাওলানা সাদ যাতে বিশ্ব ইজতিমায় না আসতে পারেন সে জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানানো হয়। আর যদি আসেন তাহলে ভারতের তাবলিগের দুই গ্রুপকেই আনতে হবে বলে তারা জানান। পরে সরকারের উদ্যোগে আলেমদের একটি প্রতিনিধিদল গত ২৪ ডিসেম্বর ভারত সফর করেন। সফর শেষে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি প্রতিবেদনও দেন। এ নিয়ে পরে আলেমদের নিজেদের মধ্যে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ গত ৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সচিবালয়ে আলেমদের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে পুলিশের আইজি, তিনজন সচিব ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আলেমরা আবারও মাওলানা সাদকে বিশ্ব ইজতেমায় না আনার পক্ষে মত দেন।
এ দিন সকালে উত্তরার আয়েশা মসজিদ চত্বরের এক সমাবেশ থেকেও আলেমরা মাওলানা সাদের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ইজতেমায় তাকে না আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। সর্বশেষ বৈঠকে আল্লামা শফীও তাদের পক্ষে মত দিয়ে বক্তব্য পাঠান। গত ৭ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া মাদরাসায় আবার বৈঠক করেন আলেমরা।
জানা যায়, ওই বৈঠকে উপস্থিত ২১ জনের মধ্যে ১৩ জন এবারের ইজতেমায় মাওলানা সাদ কান্ধলভি না আসার পক্ষে মত দেন। তারা হলেন বেফাকের সিনিয়র সহসভাপতি মাওলানা আশরাফ আলী, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুহাদ্দিস মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, তাবলিগের শূরা সদস্য মাওলানা মোহাম্মাদ যোবায়ের, মাওলানা মুহাম্মাদ হোসাইন ও মাওলানা ফারুক, বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী শিক্ষাসচিব মাওলানা আনাস মাদানী, তাবলিগের শূরা সদস্য মাওলানা উমর ফারুক ও মাওলানা রবীউল হক, শাইখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মাওলানা মিযানুর রহমান সাঈদ, হাটহাজারীর মুফতি কেফায়েতুল্লাহ, মাওলানা মুফতি মোহাম্মাদ আলী, ভারত সফরকারী প্রতিনিধিদলের সদস্য জামিয়া রাহমানিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক।
একই সাথে এই ১৩ জন সদস্য মাওলানা মুহাম্মাদ সাদ ও মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ এবং নেজামুদ্দীনের বাইরের মাওলানা ইবরাহীম দেওলা ও মাওলানা আহমাদ লাট না এসে তাদের প থেকে প্রতিনিধি পাঠানোর পক্ষে মতামত দেন। অপর দিকে সাতজন মাওলানা সাদ আসার পে মত দেন। তারা হলেন, তাবলিগের শূরার সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, মাওলানা আবদুল হামিদ মাছুম, মুহাম্মাদ খান শাহাবুদ্দীন নাসিম, মাওলানা জিয়া বিন কাসেম, ইউনুছ শিকদার, মাওলানা মোশাররফ হোসাইন ও আনওয়ার হোসাইন। বৈঠকের সভাপতি মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে উপর্যুক্ত চারজন না এসে তাদের প থেকে প্রতিনিধি আসার সিদ্ধান্ত দেন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত ওই দিন রাতেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে হস্তান্তর করা হয়।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কাকরাইল মারকাজ সূত্রে জানা যায়, আজ ঢাকায় আসছেন মাওলানা সাদ কান্ধলভি। বেলা দেড়টায় তিনি যাত্রা করবেন বলে সূত্রটি জানায়। মাওলানা সাদ ও নেজামুদ্দিনের সদস্যদের বাংলাদেশ সরকার বিশেষ কূটনৈতিক ভিসা দিয়েছে বলে কাকরাইল থেকে জানানো হয়। তারা এরই মধ্যে বাংলাদেশগামী বিমানের টিকিটও বুকিং দিয়েছেন বলে সূত্রটি জানায়।
এ ব্যাপারে ভারত সফর করা প্রতিনিধিদলের সদস্য মাওলানা মাহফুজুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছি। মাওলানা সাদসহ অন্যদের না এনে তাদের চারজন প্রতিনিধি পাঠাতে বলা হয়েছে। তবে সরকার কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা আমরা এখনো জানি না।
কাকরাইল মারকাজের শূরা সদস্য প্রকৌশলী ওয়াসিফুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো জানতে পারিনি। তবে মাওলানা সাদ প্রতিবারই বিশ্ব ইজতেমায় আসেন। এ বছরও তিনি আসবেন বলে আশা করছি। এ ব্যাপারে সরকার পজিটিভ সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশা করেন তিনি।