আবারও ৩ থেকে ৬ মাসের বেতন বকেয়া পড়েছে বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দৈনিক মজুরী ভিত্তিক শ্রমিকদের। বেতন না পাওয়ায় বাসা ভাড়া, মুদি দোকানের মাসিক বিল, দৈনন্দিন সাংসারিক খরচ, ছেলে-মেয়েদের স্কুলে ভর্তিসহ নানাবিধ খরচ চালাতে পারছেন না তারা। এদের মধ্যে ৩-৪ মাসের বাসা ভাড়া বকেয়া হওয়ায় অনেককে ভাড়া পরিশোধ করে বাসা ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ করেছেন বাড়ির মালিকরা। এতে বেকায়দায় পড়েছেন তারা। এ অবস্থায় বকেয় বেতনের দাবিতে ফের আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
যদিও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. ওয়াহিদুজ্জামান।
বকেয় বেতন এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডে অর্থ বরাদ্দসহ বিভিন্ন দাবিতে গত বছরের এপ্রিল মাসে ৫ দিনব্যাপী আন্দোলন করে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে সিটি করপোরেশনের সব ধরনের নাগরিক সেবা বন্ধ হয়ে যায়। টানা ৫দিন নাগরিক সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ৫৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বরিশাল সিটি করপোরশন ময়লা-আবর্জনার ভাগারে পরিণত হয়। দুর্গন্ধে রাস্তাঘাটে চলাচল দায় হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক সহ সুশীল সমাজের মধ্যস্থতায় সিটি মেয়র আহসান হাবিব কামাল এবং আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ওই বৈঠকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৩৫ মাসের প্রভিডেন্ট ফান্ডের বরাদ্দ, অল্পদিনের মধ্যে একসাথে দুটি, পরের মাসে দুটি, এর পরের মাসে আরো দুটি বকেয়া বেতন এবং প্রতি মাসের ১০ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে প্রতিমাসের বেতন পরিশোধ করার সমঝোতা হয়। এছাড়া দৈনিক মজুরী ভিত্তিক কোন শ্রমিক মারা গেলে তার পরিবারকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার সমঝোতা হয়।
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখার উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী পরিষরদের সাংগঠনিক সম্পাদক মাবুবুর রহমান নিপু জানান, ওই সমঝোতা বৈঠকের পর এক সাথে দুই মাসের বেতন, এরপর আরো দুই মাসের বেতন এবং ৬টি প্রভিডেন্ট ফান্ডের বরাদ্দ দেওয়া হয়। সবশেষ ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আবারও ৬ মাসের বেতন এবং প্রায় ৩০ মাসের প্রভিডেন্ট ফান্ড বকেয়া হয়েছে।
বিসিসি’র দৈনিক মজুরী ভিত্তিক শ্রমিক মো. মোতালেব বলেন, ৬ মাসের বেতন বকেয়া পড়েছে। অভাব-অনটনে মানবেতর জীবনযাপন চলছে। মেয়র, সিইও’র কাছে বেতন চাইলে বেতন দেয় না। অথচ সিটি কপোরেশনে বছরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়। আদায় হওয়া রাজস্ব দিয়ে ঠিকাদারদের বিল দিয়ে দেয়। ঠিকাদারদের বিলে তারা পার্সেন্টেজ পায়, কর্মচারীদের বেতন দিলে পার্সেন্টেজ পাবে না, তাই তাদের বেতন দেয় না।
অস্থায়ী কর্মচারী জিনাত লায়লা বলেন, তাদের (অস্থায়ী) ৪ মাসের বেতন বকেয়া হয়েছে। বেতনের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কিছুই বলে না। কবে পাবেন তাও অনিশ্চিত। জোড়াতালি দিয়ে চলছে তার সংসার।
বিসিসি’র ভান্ডার শাখার কাওছারী খান বলেন, দুঃখের সাথে জানাচ্ছি ৭ মাস বেতন পাইনা। বলার আর ভাষা নাই। সংসার চলছে কোন রকম ধার দেনা করে।
প্রকৌশল শাখার মাস্টার রোল কর্মচারী মিন্টু চন্দ্র রায় জানায়, তারা ৩ মাস বেতন পান না। মানবেতর জীবন-যাপন করতেছি। বাড়িওয়ালা-দোকানদার অকাথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। মেয়র-সিইও’র কাছে গেলে তারা শুধু আশ্বাস দেয়, বেতন দেয় না।
বিসিসি’র বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী পরিষদের নেতা ও পরিছন্নতা কর্মকর্তা দিপক লাল মৃধা জানায়, ৬ মাসের বেতন বাকি, ২০ মাসের উপরে প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গ্রাচুইটি বাকি পড়েছে। সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। জানুয়ারী মাস, টাকার অভাবে সবার ছেলে-মেয়ে স্কুলে ভর্তি করতে পারছে না। এ কারণে কারোর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
দিপক মৃধা বলেন, তারা আন্দোলন-সংগ্রাম চান না। বেতন-প্রভিডেন্ট ফান্ড চান। সেটা নিয়মিত না দেওয়া হলে সাধারণ কর্মচারীরা যদি আন্দোলনে যায়, তখন কিছুই করার থাকবেনা। ওই আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী পরিষদও সমর্থন দেবে বলে হুশিয়ারী দেন তিনি।
বিসিসি’র নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, অন্য কেউ নিয়মিত বেতন না পেলেও সিইও, সচিব, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, প্রধান পরিকল্পনাবিদ এবং অস্থায়ী হয়েও মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে বিসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, সিটি করপোরেশনের বার্ষিক এবং বকেয়া রাজস্ব আদায় সাপেক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করা হবে। কারণ তহবিলে টাকা না থাকলে বেতন দেওয়ার উপায় নেই।
উল্লেখ্য, বরিশাল সিটি করপোরেশনে দৈনিক মজুরী ভিত্তিক ও অস্থায়ী প্রায় ১৬শ’ শ্রমিক এবং ৫২০জন স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রতিমাসে বেতন প্রায় ৩ কোটি টাকা।