কলামিস্টঃ আর.এম।।
কয়েক মাস আগে রংপুর টাউন হল চত্বরে একটি জনসভা হচ্ছিল। সেই জনসভার ব্যানারে লেখা ছিল ‘ভাত দে মা’। এই সভাটি হচ্ছিল বেতনবিহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের। দেশে যখন বিভিন্ন উন্নয়নের লেভেল যুক্ত হচ্ছে, তখন ভাত চেয়ে শিক্ষকেরা সভাও করছেন। শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে জাতি কতখানি মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়াবে সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
গত কুড়ি বছরে দেশে অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সরকার তার পাঠদানের অনুমোদনও দিয়েছে। এরপর থেকে ওই স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে, পাস করছে। পরে তারা উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করছে। চিকিৎসক-প্রকৌশলী-বিসিএস ক্যাডারও হচ্ছে। কিন্তু ওই স্কুল কিংবা কলেজ এর অনেক শিক্ষক এখন পর্যন্ত কোনো বেতন পাননি। তীর্থের কাকের চেয়েও অসহায়ভাবে অপেক্ষা করছেন। বেতনের আশায় বুকে বেঁধে আছেন। প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার সময় এলেই এসব শিক্ষক খবরগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন, যদি কোনো ঘোষণা আসে। এসব শিক্ষক অন্যের বাড়িতে দিনমজুরি খাটতে পারেন না, রিকশা-ভ্যান চালাতে পারেন না। বিয়ে করলেও শ্বশুরবাড়িতে কোনো সম্মান পান না। সন্তানের কাছে মাথা নিচু হয়ে আসে। সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হন। কোনো দোকানদার তাঁদের বাকি দেন না। যেকোনো উৎসব তাঁদের কাছে অভিশাপের মতো। বাজারের সবচেয়ে কম দামে কেনা পোশাক পরে মনের ভেতর যন্ত্রণা পুষে রেখে মুখে হাসির অভিনয় করে শ্রেণিকক্ষে যান আমাদের এ রকম লক্ষাধিক শিক্ষক। কোনো কোনো শিক্ষক না খেয়েও ক্লাস করান।
গত কুড়ি বছরে অনেক নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় মাধ্যমিক হয়েছে, অনেক নতুন স্কুল-কলেজও হয়েছে, যেগুলোতে বেতন চালু হয়নি। আবার অনেক কলেজ এমপিওভুক্ত হলেও সেখানকার অনেক শিক্ষক বেতন পান না। এসব শিক্ষককে ঠকানোর অধিকার এ দেশের জনগণ এ দেশের সরকারকে দেয়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা সবাই চান বেতনহীন শিক্ষকদের বেতন হোক। এই বেতন না দেওয়াটা অত্যন্ত অমানবিক।
আমাদের দেশের শিক্ষামন্ত্রী লাখ লাখ শিক্ষকের বেতনের ব্যবস্থা না করে নিজে ভালো থাকার কথা নয়। তাঁর পক্ষেতো বিনা পারিশ্রমিকে একজনের কাছ থেকে এক দিনেরও শ্রম কেনার কথা নয়। শিক্ষামন্ত্রী যদি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতনের ব্যবস্থা করতে না পারেন, তাহলে এগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিল করা উচিত ছিল। বিনা পারিশ্রমিকে বাধ্যতামূলকভাবে সেবা গ্রহণ করাটা স্বাধীন দেশের নাগরিকের জন্য অপমানজনক।
এসব বেতনবিহীন শিক্ষকের করুণ জীবনগাথা যদি পাষাণহৃদয় কেউ শোনেন, তাহলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারবেন না। তাঁদের যন্ত্রণা পাষাণহৃদয়কে ঘুমাতে দেবে না।
কয়েক বছর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করেছেন। আমরা চাই যেসব শিক্ষকের বেতন এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি, অনতিবিলম্বে তাঁদের বেতনের ব্যবস্থা করা হোক। শুধু বেতন চালুকরণ নয়, বকেয়াসহ বেতন দেওয়া জরুরি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, দেশে এখন পর্যন্ত যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, তার প্রায় সবই প্রথম অবস্থায় স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরাই প্রতিষ্ঠা করেছেন। পরবর্তী সময়ে সেগুলো সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছে। যদি আগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পেয়ে থাকে তাহলে পরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও তা অধিকার।
কথা উঠতে পারে শিক্ষকদের নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করায় কোনো নিয়ম লঙ্ঘন হয়েছে কি না, সেসব নিয়ে। কিন্তু পাঠদানের অনুমোদন দেওয়ার পর আর বেতন না দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। যদি এসব প্রতিষ্ঠান অপ্রয়োজনীয় হয়, তাহলে যারা অনুমোদন দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তা তো হয়নি। তা ছাড়া একবারও সরকার এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনাও দেয়নি। যদি এসব শিক্ষকের শ্রম ও সেবা সরকার অপ্রয়োজনীয় মনে না করে, তাহলে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এঁদের এমপিওভুক্ত করা প্রয়োজন। এসব শিক্ষকদের জন্য তাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের অপরাধবোধ কাজ করে। শুধু বোধোদয় হয় না রাষ্ট্রীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের। যাদের হাতে এর সুষ্ঠু সমাধান রয়েছে।
আমরা চাই এ কষ্ট লাঘবে বর্তমান সরকারই পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।