দেশে ফিরে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দায়িত্ব গ্রহণ সুদূর পরাহত বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। শনিবার (১৪ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৬টায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, উনার ( এস কে সিনহা) সঙ্গে ৫ জন বিচারপতি যদি বসতে না চান তাহলে তো বিচার বিভাগে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে। সুতরাং বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করলে আবার ফিরে এসে বসা সুদূর পরাহত হবে। একইসঙ্গে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগ সরাসরি উল্লেখ করেননি তিনি। তবে বিষয়টি রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতিরা অবহিত বলে জানান তিনি।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘একইসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা বিচারিক কাজ পরিচালনা, বেঞ্চ গঠনসহ সব দায়িত্ব তিনি সাংবিধানিকভাবে পালন করতে পারবেন।’
মাহবুবে আলম বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছিল, এ বিবৃতির মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটবে।’
প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সেগুলো আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে আছে। বিবৃতিতেও সেগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়নি। রাষ্ট্রপতিও বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু তিনি প্রধান বিচারপতি সেহেতু সংযত হয়ে এ বিষয়ে কথা বলা হয়েছে।’
সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া এই বিবৃতিকে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বক্তব্য উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘গতকাল প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া সফরে যাওয়ার সময় তার বাসভবনের সামনে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে দেশবাসী বিভ্রান্ত হয়েছেন। দেশবাসীর এই বিভ্রান্তি দূর করতে পাঁচ বিচারপতির আজ শনিবার দেওয়া বিবৃতিটির প্রয়োজন ছিল।’
তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট থেকে আজ শনিবার যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে এটি আপিল বিভাগের বর্তমান পাঁচ বিচারপতির পক্ষ থেকে করা হয়েছে। এ বিবৃতিতে রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষর করেছেন। এ বিবৃতি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল এজন্য যে গতকাল (শুক্রবার) প্রধান বিচারপতি বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে নাটকীয়তা সৃষ্টি করেছেন এবং লিখিত একটি বিবৃতি তিনি সাংবাদিকদের দিয়ে গেছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীকে এ তথ্য জানানো প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি। সেটা উনারা এখানে স্পষ্ট করে বলেছেন।
বিবৃতির শেষ প্যারার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির পদটি একটি প্রতিষ্ঠান। সে পদের ও বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে ইতোপূর্বে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে কোনও বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদান করা হয় নাই। কাজেই প্রধান বিচারপতি যে বিবৃতি দিয়ে গেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট যদি বসে থাকতো তাহলে দেশবাসী একটি বিভ্রান্তিতে পড়ে যেতো। দেশবাসীর কাছে এসব ঘটনা স্পষ্ট করার প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি।’
প্রধান বিচারপতি যাওয়ার সময় বলে গেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি শুধু রুটিন কাজগুলো করবেন তা সঠিক নয় উল্লেখ করে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘যিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তিনিও কিন্তু সাংবিধানিক পদেই আছেন। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। সুতরাং বিচারালয়ের নীতিগত সিদ্ধান্ত, বিচারিক কাজ, বেঞ্চ গঠনসহ যাবতীয় কাজ তিনি করবেন। সব দায়িত্ব তিনি পালন করবেন।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটাতো যৌক্তিক কোনও কথা হল না যে একজন প্রধান বিচারপতি যখন দেশের বাইরে থাকবেন তখন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নীতিগত কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।’
এ বিবৃতির মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির কাজ নিয়ে যে বিতর্ক ছিল তার অবসান হলো বলে মনে করেন তিনি।
এ অভিযোগের পর প্রধান বিচারপতি তার পদে থাকতে পারেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পাঁচ জন বিচারপতি যদি তার সঙ্গে বসতে না চান তাহলে বিচার বিভাগে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হবে। এ অবস্থা বিবেচনা করলে উনি ফিরে এসে স্বদায়িত্বে ফেরা সুদূর পরাহত হবে।
সুস্থ-অসুস্থ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘যখন চিঠি লিখেছিলেন তিনি নিজেকে অসুস্থ বলেছিলেন। আর গতকাল বিদেশ যাওয়ার সময় বলছেন তিনি সুস্থ। দুটিই তার বক্তব্য।’
উল্লেখ্য, অবকাশ শেষে সুপ্রিম কোর্ট খোলার আগের দিন ৩ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হঠাৎ করে এক মাসের ছুটি চেয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর আবেদন করলে বিষয়টি নিয়ে তীব্র আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এর আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায় এবং বিচারিক আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি সংক্রান্ত গেজেট নিয়ে সরকারের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় প্রধান বিচারপতিকে জোর করে ছুটিতে পাঠানোর অভিযোগ তোলেন বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদসহ আইনজীবী সমিতির একাংশ। তবে সরকার ও আওয়ামী লীগ এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। সর্বশেষ গতকাল ১৩ নভেম্বর শুক্রবার রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে নিজ বাসভবনের সামনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। সেখানে তিনি নিজেকে ‘সুস্থ’ বলে দাবি করলে এবং উদ্ভূত ঘটনায় ‘বিব্রত’ হয়েছেন বলায় বিষয়টি নিয়ে আবারও আলোচনার সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে আজ শনিবার সুপ্রিম কোর্ট থেকে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতিকে উদ্ধৃত করে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। এতে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনসহ ১১টি গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে বঙ্গভবনে গিয়ে সেখানে এসব অভিযোগ সম্পর্কে তারা অবহিত হন এবং এ সংক্রান্ত প্রমাণ তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বলেও ওই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি ২ অক্টোবর এসব অভিযোগ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতির কাছে জানতে চাইলে তিনি সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন এবং প্রয়োজনে পদত্যাগ করবেন বলে তাদের জানান এবং পরদিন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা বলেন। জবাবে বিচারপতিরাও তাকে (এস কে সিনহা) জানান, এসব অভিযোগের সমাধান না হলে প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার সঙ্গে একসঙ্গে বসে বিচারকাজ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এর পরদিন ৩ অক্টোবর এক মাসের ছুটির আবেদন করেন তিনি। আগামী বছরের ৩১ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে এস কে সিনহার মেয়াদ শেষ হবে।