কলামিস্টঃ আর.এম।।
কি দোষ ছিলো পঠুয়াখালীর মিতুর (ছদ্ধ নাম )? মেয়েটার মা পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন সে সারারাত মায়ের সেবা করে হাসপাতাল থেকে দশমিনায় বাসায় ফিরছিল। ভাড়ায় চালিত এক মোটরসাইকেলে উঠেছিল। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মোটরসাইকেলটি মিলঘড় এলাকার বটতলার সানু মৃধার বাড়ির কাছে পৌঁছালে ৪ দুর্বৃত্ত চলন্ত মোটরসাইকেলের গতি রোধ করে ড্রাইভারকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে পাঠিয়ে দেয় এবং মেয়েটির মুখ চেপে কাছেই একটি পরিত্যক্ত ভিটায় নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। একটু ভেবে দেখুন, পবিত্র ঈদের দিন সকালে এ ঘটনা ঘটেছে যখন বিশ্বাসী মুসলমান ঈদের জামাত ও কোরবানি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন!
যখন বনানীর রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের দাওয়াতের নাম করে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হল তখনও শুনেছি, মেয়েটারই দোষ, রাতবিরেতে বেরোয় কেন? রংপুর থেকে ফেরার পথে রূপা নামে যে মেয়েটিকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করা হল, সেখানেও এক কথা– নিজের নিরাপত্তার কথা নিজেকেই ভাবতে হয়। বিপদের আশঙ্কা আছে জেনেও মেয়েটা একা বাসে গেল কেন? থার্টি ফাস্ট নাইটে বাঁধন নামক মেয়েটির ওপর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কিছু পুরুষ হামলে পড়েছিল তখনও শুনেছি, মেয়েরা কেন মধ্যরাতে আমোদ করতে যাবে! পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে দিনেদুপুরে টিএসএসসিতে যখন মেয়েরা নাজেহাল হল তখনও সাবধানীরা যুক্তি দিয়েছে, দিনকাল খারাপ, মেয়েদের একটু সমঝে চলা দরকার!
সবখানে একই যুক্তি, একই কথা– মেয়েদেরই দোষ। ওরা পর্দা করে না। ‘উগ্র’ পোশাক পরে। ‘উচ্ছৃঙ্খল’ চলাফেরা করে। ধর্ম মানে না। আদব মানে না। তাই ওরা পুরুষদের লালসার শিকার হয়। এসব ব্যাপার নিয়ে অনেকের সঙ্গেই তর্ক হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ পুরুষের তেমন কোনো দোষ খুঁজে পায় না। সব আলোচনার শেষ কথা হল– দোষ মেয়েদেরই!
এসব দেখেশুনে মনে হয় আমরা চিন্তা-চেতনায় ক্রমেই যেন ছয়শ বছর আগে ফিরে যাচ্ছি! সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছিল বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ঘটনাটির পর। আমার ‘শিক্ষিত’ বন্ধুরা পর্যন্ত রুষ্ট গলায় বলেছে, মেয়েটি অত রাতে হোটেলে যাবে কেন? তার বাপ-মাই-বা কেন তাকে রাতের বেলা পার্টিতে যেতে দিয়েছিলেন? অত্যন্ত সঙ্গত প্রশ্ন। এসব ক্ষেত্রে যুক্তিবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। মাথা কাজ করে না। তখন মনে হয়, ‘নারীবিরোধী’ মানুষগুলোই ঠিক কথা বলছেন।
হিটলার না-হয় ইহুদিদের সাবাড় করেছেন, ইহুদিরা কি তাদের কাজেকর্মে হিটলারকে প্ররোচিত করেনি? বনানীকাণ্ডের সেই শিক্ষার্থী কিংবা টাঙ্গাইলে চলন্তবাসে ধর্ষণের শিকার হওয়া মেয়েটি, কিংবা দশমিনার সেই হতভাগী কি জানত না, সমাজে থাকতে গেলে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে, সরে-সরে, এড়িয়ে চলতে হয়? সে শেখেনি, বুক-মুখ লুকিয়ে চোখ নিচু করে সমাজে চলতে হয়? মেয়ে হয়ে ঘুরবে ফিরবে আর পুরুষগুলোর মনে কাম-লালসা জাগবে না? বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের যুক্তি-চেতনা-আচরণ বর্তমানে এই স্তরে এসে ঠেকেছে।
মেয়েদের পোশাক নিয়ে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই রয়েছে ব্যাপক আপত্তি। মেয়েদের মিনিস্কার্ট-জিন্স-মোবাইল-ফেসবুক নিয়ে সুদৃঢ় আপত্তি জানান শিক্ষিত মানুষজন পর্যন্ত। তাদের ভাষায়: সারাক্ষণ বেলেল্লাপনা করে বেড়াবে, ছেলেদের সঙ্গে ঢলাঢলি করবে, উত্তেজনা উসকে দেবে, তারপর সে ঝাঁপিয়ে পড়লে ‘নারীবাদী’ যুক্তি দিয়ে সাফাই গাইবে, এ তো সততার অপমান।
কেউ বলছে, নিজেকে রক্ষার কৌশলগুলো তুমি নিজে বুঝে নেবে না? কেউ তর্ক করছে, প্রশাসন কেন মেয়েদের রক্ষা করবে? আরে, তুমি প্রত্যহ দেশের ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি কলা দেখাবে, কিছুতে ঘরোয়া-সুশীলা হবে না, আর বিপদে পড়লে অমনি দেশের প্রশাসনের শরণ নেবে? এটা হয় নাকি? কেউ বলছে, ছেলেরা কেন নিজেদের সংযত করবে না? আত্মসংবরণের দায় কেন তাদের নেই?
এমন এক আলোচনায় একজন সরকারি চাকুরের মুখে শুনেছিলাম আরও আজব কথা। তার ভাষায়: “কী মুশকিল, এ তো ছেলেদের শরীরধর্ম। তার হরমোন নিঃসরণ তো তার হাতে নেই। কোনো ছেলেই ইচ্ছে করে ধর্ষণ করে না। আপ্রাণ চেষ্টা করে না-করার। কিন্তু ডায়েটিংএর প্রতিজ্ঞা শেষ অবধি কজন রাখতে পারে? কজন সামনে রগরগে ফুচকা দেখেও মুখ নিচু করে তেত্তিরিশের নামতা জপতে পারে?”
এসব শুনে শুনে নিজেরও মত একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে। আসলেই মেয়েরা আর ছেলেরা সমান নয়। সাম্য একটা অনুচিত ধারণা। দুনিয়াকে শক্তি দেখিয়ে অধিকার করা দিগ্বিজয়ী পুরুষ। আর ন্যাকা, অবগুণ্ঠিত, চব্বিশ বাই সাত ধর্ষণের ভয়ে কাঁপতে থাকা নারী সমান? সোজা কথা, মেয়েরা দেহে আনফিট– মনে কাঁদুনে– আর রূপের পুঁটুলি ভোগের রসগোল্লা। তাই তাদের নিরাপত্তার জন্যেই, সস্নেহ উদ্বেগে, ছলছল মমতায়, ছেলেরা তাদের ঘরের মধ্যে ঠুসে দিয়েছে। দিয়েছে বলেই এ দেশ এত জন অসামান্য সন্তান পেয়েছে। কারণ তাদের মায়েরা, সন্তানদের আয়ার ঘাড়ে ফেলে ড্যাংডেঙিয়ে অফিস করতে বেরিয়ে পড়েনি। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে ছেলের হাতে একটা চিপস আর আর দুটো চুমু দিয়ে মোবাইল-ফেসবুক নিয়ে বসেনি। তারা সারা দিন বাড়িতে থেকে, প্রাণ দিয়ে বাচ্চা মানুষ করেছে। এই দায়িত্ব পেয়ে রোমে রোমে অনুভব করেছে, তারা মায়ের জাত।
মেয়েদের প্রতি এই অশেষ শ্রদ্ধার জন্যই তাদের কাছে আমাদের পুরুষেরা মহাকাব্যিক আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশৃঙ্খলা দাবি করে। শিক্ষক যেমন মদ খেয়ে ক্লাসে পড়াতে পারেন না,আমাদের পুরুষতান্ত্রীক সমাজে মনে হয় নারীও তেমন নিজের আনন্দে অগ্রাধিকার দিয়ে জীবনযাপন করতে পারে না।