জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল সমকামীদের মৃত্যুদণ্ড বিলোপের যে প্রস্তাব তুলেছে, তার বিপক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ৷ তবে প্রস্তাবটি পাস হয়েছে৷ ৪৭ সদস্যের ২৭ সদস্য মৃত্যুদণ্ড বিলোপের পক্ষে আর বিপক্ষে ভোট দিয়েছে ১৩ সদস্য৷
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে সমকামীদের মৃত্যুদণ্ড বিলোপের বিপক্ষে শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, জাপান, বতসোয়ানা, বুরুন্ডি, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরাক, কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও ভোট দিয়েছে৷
সমকামীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার আইন রয়েছে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে৷ তবে দীর্ঘ দিন ধরেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে আসছে, সমকামিতা কোনো অপরাধ নয়৷ সে দাবির প্রেক্ষিতেই সমকামীদের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি তুলে দেওয়া হোক– এই মর্মে একটি প্রস্তাব আনা হয় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে৷
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ৪৭ জন সদস্যের মধ্যে ২৭ সদস্য মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়ার পক্ষে ভোট দেয়৷ ১৩ জন সদস্য ভোট দেয়ার পাশাপাশি, সাতটি সদস্য রাষ্ট্র ভোট দানে বিরতও থাকে৷ তারপরও মৃত্যুদণ্ড তুলে দেয়ার প্রস্তাবটি পাশ হয়েছে৷
বিশ্বের ছয়টি দেশে সমকামিতাকে মৃত্যুদণ্ডতুল্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ দেশগুলো হলো: সৌদি আরব, ইরান, সুদান, ইয়েমেন, নাইজেরিয়া এবং সোমালিয়া৷
বাংলাদেশে সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ তবে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য কোনো অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না৷ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী, সমকামিতার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অন্য কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড, যা ১০ বছরও হতে পারে৷ এই আইনে একই সঙ্গে অর্থদণ্ডেরও বিধান আছে৷ দণ্ডবিধিতে সমকামিতাকে প্রাকৃতিক নিয়মবিরুদ্ধ যৌনতা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও প্রাকৃতিক নিয়মের কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নাই৷
এ নিয়ে মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সমকামীদের মৃত্যুদণ্ড বিলোপের বিপক্ষে বাংলাদেশের ভোট দেয়ার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং এখানেও মৃত্যুদণ্ড চালু হবে৷ বাংলাদেশের আইনে এর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ সমকামীতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ তার সেই কঠোর অবস্থানই প্রকাশ করছে৷ ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে সমকামীতার পক্ষে অবস্থান নেয়ার কোনো সুযোগ বা অবস্থা সরকারের নাই৷’’
বাংলাদেশের ইনভিজিবল মাইনরিটি:
বাংলাদেশে সমকামী বা এলজিবিটি কমিউনিটির লোক থাকলেও তাঁরা এখনও ‘ইনভিজিবল মাইনরিটি’৷ বাংলাদেশে সমকামীদের সবচেয়ে বড় গ্রুপ ‘বয়েজ অব বাংলাদেশ’ (বিওবি)৷ ‘গে বাংলাদেশ’ নামে আরো একটি সমকামী গ্রুপের নাম জানা যায়৷ এই গ্রুপ দু’টি অনলাইন ভিত্তিক৷ তবে তাদের এখন আর সক্রিয় দেখা যায় না৷
বাংলাদেশে সমকামীদের ‘ইনভিজিবল মাইনরিটি’ শিরোনামে গবেষণা করেছে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংগঠন গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্স (জিএইচআরডি)৷ ২০১৫ সালের ১৭ জুন প্রকাশিত ওই গবেষণাটি করা হয় বাংলাদেশের ৫০ জন সমকামী এবং সমকামী নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে৷ আর সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সমকামীদের ব্যাপারে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক৷ আইনে সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷
প্রতিবেদনে সমকামীরা তাঁদের প্রতি নির্যাতন এবং হুমকির কথাও বলেছেন৷ বলেছেন, আইনি বৈষম্য এবং মানবাধিকার লংঘনের কথা৷ এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সমকামীর সংখ্যা কত তা বলা হয়নি৷ আর এ নিয়ে কোনো জরিপের খোঁজও পাওয়া যায়নি৷ তবে জানা গেছে, বয়েজ অব বাংলাদেশ গ্রুপের নিবন্ধিত সদস্য সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি৷ আর এই গ্র্রুপের সদস্যরা শিক্ষিত, এমনকি পিএইচডি ডিগ্রীধারীও আছেন৷
২০১৫ সালের জুন মাসে সমকামীরা ঢাকায় ঘরোয়াভাবে ‘ধী-এর গল্প’ নামে সমকামীদের একটি কমিক স্ট্রিপ প্রদর্শন করেন৷ এর আগেও সমকামীরা ‘রূপবান’ নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন৷ প্রকাশ করা হয় সমপ্রেমী কবিতার বই ‘রুপঙতি’৷
গত বছরের ২৫ এপ্রিল ঢাকার কলাবাগান এলাকায় সমকামীদের অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘রূপবান’ সম্পাদক জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে হত্যা করা হয়৷
দু’জনের হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন আগে গত বছরের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের দিন এলজিবিটিরা ‘রংধনু’ র্যা লি বের করার চেষ্টাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা এলাকা থেকে চার জন সমকমীকে আটক করে পুলিশ৷
আর চলতি বছরের ১৯ মে র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যা ব) ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের আটিবাজার ছায়ানীড় কমিউনিটি সেন্টার থেকে ২৭ জন সমকামীকে আটক করে৷ তাঁরা ওই কমিউনিটি সেন্টারে একত্রিত হয়েছিলেন৷ পরে তাঁদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা দিয়ে পুলিশ রিমান্ডেও নেয়া হয়৷
নানা পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, জুলহাজ-তনয় হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশে এলজিবিটি অধিকার সংক্রান্ত তৎপরতা থমকে গেছে৷ তাঁদের ওপর পুলিশের নজরদারি এবং চাপও বেড়ে গেছে৷ যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের একাংশ দেশের বাইরে চলে গেছেন৷ আর যাঁরা আছেন, তাঁরা এখন আর প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা চালাচ্ছেন না৷
এই পরিস্থিতি নিয়ে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘‘তাঁদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশে পদক্ষেপ নেয়ার মতো কোনো অবস্থা নাই৷ ধর্মীয় এবং সামাজিক গোষ্ঠীর চাপের মুখে তাই বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকলেও তার পক্ষেই অবস্থান নিতে হয় সরকারকে। ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ কেউ অধিকারের কথা বললেও তা বাস্তবে এখনো সম্ভব নয়৷’’
প্রসঙ্গত, ভারতেও সমকামীতাকে অপরাধ হিসেবে গন্য করা হয়৷ সকামীদের অধিকার রক্ষা এবং শাস্তির বিধান বিলোপ করতে গিয়ে আইনি লড়াই চালিয়েও শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টে গিয়ে হেরে যায় সমকামী অধিকার কর্মীরা৷