রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের ব্যাপারে ভারতের সাথে আলোচনা শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন, এই ইস্যুতে দুটো দেশ একসাথে আছে এবং একসাথে থেকেই তারা এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেছেন, এবিষয়ে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের চুপ থাকা নিয়ে বাংলাদেশের সরকারের ভেতরে ও বাইরে চাপা ক্ষোভের মধ্যেই পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক অন্তত প্রকাশ্যে একথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন তার সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বিবিসির দিল্লি সংবাদদাতা শুভজ্যোতি ঘোষ।
বাংলাদেশ সরকার চাইছে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে ভারত সরকার আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা নিক। কিন্তু এবিষয়ে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট কোন আশ্বাস পেয়েছে কিনা তার সফরে এবং বক্তব্যে সেটা স্পষ্ট হয়নি।
তবে মি. হক জানিয়েছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে ভারত যেভাবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ওপর জোরালো অবস্থান নিয়েছে তাতে বাংলাদেশ সরকার খুশি।
তিনি বলেন, অনেক দেশই কিন্তু অনেক কথা বলেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্যে ত্রাণ-সাহায্য ভারতই পাঠিয়েছে প্রথম।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যে জাতীয় বা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে, ভারতের এই মূল্যায়নের সঙ্গেও বাংলাদেশ একমত বলে জানান তিনি।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে বৈঠকের পর দিল্লিতে শুক্রবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে ভারতের কাছ থেকে তারা এধরনের সহযোগিতাই আশা করেছিলেন।
ভারত সরকার বলে আসছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন জাল ছড়াতে চাইছে এবং তাদের মধ্যে থেকে নতুন ‘রিক্রুট’ নিয়োগের চেষ্টা চালাচ্ছে।
গত মাসে আদালতে হলফনামা দিয়ে দিল্লি সরকার রোহিঙ্গাদেরকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবেও চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জানান, তারাও এই বিপদের সম্ভাবনাটি সম্পর্কে অবহিত।
মি হকের কথায়, “যখনই জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়, বিশ্বের যে কোন প্রান্তেই তারা একটা হুমকি। তারা সে অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। হাতের কাছে ইউরোপেই এর সাম্প্রতিক উদাহরণ আছে, এছাড়া মধ্য এশিয়া বা লাতিন আমেরিকাতেও অনেক জায়গাতেই এ জিনিস ঘটেছে।”
“যখনই নির্যাতিত মানুষ এভাবে সীমান্ত পেরোতে বাধ্য হয়, তখনই সেখানে নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সব সময় হবেই আমি বলছি না, তা অনেকটা নির্ভর করে কীভাবে আপনি পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন তার ওপরেও।”
এখনও অবধি শেখ হাসিনা সরকার সাফল্যের সঙ্গে এই দিকটি মোকাবিলা করেছে বলেও তিনি দাবি করেছেন।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে প্রধানমন্ত্রী মোদির পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোন বক্তব্য না আসা এবং মিয়ানমার সফরে গিয়ে এবিষয়ে তার নিশ্চুপ থাকার কারণে বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা হয়েছে।
আর তাই প্রশ্ন উঠেছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে যে ইতিবাচক ভূমিকা আশা করছিল, দিল্লিতে বিভিন্ন বৈঠক ও আলোচনায় সেটা কতটা পূর্ণ হল?
বিবিসির এ প্রশ্নের জবাবে শহীদুল হক বলছিলেন, “ভারত এই ইস্যুতে যে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছে তাতে বাংলাদেশের মানুষ ও সরকার খুবই খুশি। আমরা সব সময়ই জানি, একাত্তর থেকে আজ পর্যন্ত সব সময় আমাদের বিপদে ভারত পাশে থেকেছে – ঘনিষ্ঠতম সহযোগী আর বন্ধু হিসেবে।”
“দিল্লিতে সব সময়ই দ্বিপাক্ষিক নানা বিষয়ে কথা বলতে আমরা খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করি। সব সময় যে সব ব্যাপারে একমত হই তা হয়তো নয়, কিন্তু অলোচনা করি খুবই খোলামেলা ভঙ্গীতে – আর এই ইস্যুতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।”
কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাহলে কোন কোন বিষয়ে দু’দেশ একমত হল, আর কোথাওই বা রয়ে গেল মতের অমিল?
শহীদুল হকের জবাব, “দু’দেশই এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে এটা বাংলাদেশের কাঁধে এক বিরাট বোঝা, এক বিরাট সঙ্কট – যা আমাদের পুরো অঞ্চলকেই অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। উন্নয়নের পথ থেকে ছিটকে দিতে পারে এই এলাকার সব দেশকেই।”
“আর এই পটভূমিতে ভারত সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে যে বিবৃতি দিয়েছে – যাতে তারা বলেছে এই মানুষগুলোকে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফিরিয়ে নিতে হবে – তাতে আমরা খুবই উৎসাহিত বোধ করছি।”
“আর মনে রাখতে হবে, ত্রাণ পাঠানোর ক্ষেত্রেও ভারতই কিন্তু এক নম্বরে, শুধু আকাশপথেই নয় – জাহাজেও তারা বিপুল পরিমাণ ত্রাণ পাঠিয়েছে, কাজেই এক কথায় বলতে গেলে আমরা খুব খুশি।”
তবে রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন বা অন্য নানা দেশের ভূমিকায় বাংলাদেশ খুশি কি না, পররাষ্ট্র সচিব সরাসরি তার কোন জবাব দেননি।
শুধু বলেছেন, “অনেক দেশের কাছেই হয়তো আমরা অনেক কিছু আশা করেছিলাম, যা পূর্ণ হয়নি।”
তবে রোহিঙ্গা প্রশ্নে সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক বিশ্ব যে সহমর্মিতা দেখাচ্ছে তা সঙ্কট নিরসনে ঢাকাকে আশাবাদী করে তুলেছে বলেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্য।