নজরুল ইসলাম তোফা||
মনের ক্ষুদা বড় ক্ষুদা, এ ক্ষুদা ইচ্ছে থাকা সর্তেও কখনো সখনো মিটানো যায় না হাজারও পরিশ্রম করে কিংবা গভীর ধ্যান জ্ঞানের সমন্বয় সাধনে। অবশ্য মনের ক্ষুদা মিটাতে সুদুর প্রসারী কল্পনা নিয়ে দূর্গম পথ পাড়ি জমিয়েও অনেকে হয়ে যায় ব্যর্থ। কিন্তু মিডিয়া জগতে স্বপ্নে বিভোর এবং মিডিয়াকে কর্মে বাস্তবায়নের লক্ষে এমনও কেউ আছেন, অজস্র ব্যর্থতাকে জয় করতে সর্বদা প্রস্তুত। শৈশোবের স্বপ্নবাজ সেই মুক্ত মনের মানুষ, হাজারও প্রতিকুলতায় মাঝেও জীবনের আশা আকাঙ্খা পুরনে লক্ষে অনেক গঠন মূলক ভাব ধারায় অনেক নাট্য পান্ডুলিপি লিখে বহুত দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। এমনই একজন গুনোধর, চৌকস, সৎ চরিত্রের মেধাবী যুবক প্রগাঢ় ইচ্ছা শক্তি নিয়ে শিল্প সংস্কৃতির প্রতিটি শাখায় হাত দিয়ে ক্রিয়দংশ সফল হয়েছে। কিন্তু উপার্জনের চিন্তা মাথায় ভর করলে কি আর ভালো মতো শিল্প চর্চার জগতে প্রবেশ করা সম্ভব। তবুও আর্থিক দৈন্যতার মাঝেও বৃহৎ পরিতৃপ্তিতে উপার্জনের পাশাপাশি শিল্প সংস্কৃতির চর্চার হাল ধরেই সাফল্য খোঁজেন। লেখা পড়া চালিয়ে যাওয়া আর অর্থ উপার্জনের অমশ্রিণ পথ হয়ে যায় তাঁর নিত্য সঙ্গী। আসলে তাঁর যে কোনই পথ নেই, সংসারে উপার্জন না করলে পেটে ভাতে বাঁচাতো অনেক দূরহ ব্যাপার হবে। তবুও অনেক বাধা অতিক্রম করে নির্জনে নির্ভীতে সময় পেলেই শিল্প সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় গভীর ধ্যান জ্ঞানে মগ্ন হয়ে থাকেন। নির্ম্মম বাস্তবতায় কখনো সখনো অত্যন্ত প্রিয় বিষয় লেখাপড়া থেকেও তাঁকে অনেক কষ্টে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। অর্থই জীবনের মুল যখন বুঝতে পারলেন তখন জীবন সংগ্রামে আর দেরি না করেই নেমে পড়লেন। কত শত পথ যে আরও পাড়ি দিতে হবে তিনি নিজেও মালুম করতে পারেনা না। পিতা মৃত ইসমাইল সরদারকে হারানোর পর অবশ্য তাঁর মা রুমিচা বেগমকে নিয়ে চার ভাই ও এক বোনসহ সংসার নামক জাতা কলে পিষ্ট হয়ে চলছে সংগ্রামী যুবক। মানুষের বিবেককে তাঁর সৃষ্টিশীল কর্ম হৃদয়কে অবশ্যই আন্দোলিত করবে। তিনি ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়, তাঁর ডাক নাম শরিফ। পুরো নাম হলো শরিফুল ইসলাম শরিফ।
সংসারে বড় হওয়া যে জ্বালা সে জ্বালা তিনি টের পান জীবন সংগ্রামে নেমে। যৌবনের শুরুতেই পর্বত প্রমাণ দুঃখের বোঝা বহন করতে তাঁর ক্লান্তি ভর করেছিল তা তিনি জানালেন। আবার ক্লান্তি নামক বোঝাটাও নামিয়ে রাখার বাসনা তাঁর মাঝে মধ্যে জাগ্রত হতো। বাড়ির পাশেই ছিল এক ভৈরব নদী, হেঁটে যেতে প্রায় পনের বিশ মিনিটের পথ, সে নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় পানির স্রোতে মনকে কিছুক্ষণ ভাসিয়ে এককীত্বে হাজারও কল্পনার রাজ্যে চলে যেত। একটি বাজার ছিল তাঁর বাড়ির পাশে, ‘পথের বাজারে’ তিনি বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা হৈ হুল্লড়ে কাটিয়েছেন সময়। পড়া শুনায় অনেক ভালো ছাত্র, শিক্ষা তাঁর অনেক ভালো লাগতো। ছোট থেকেই তিনি সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। লেখা পড়ার পাশাপাশি আনন্দ উল্লাসে প্রতিটি দিন ভালোই কাট ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বলা চলে তাঁর প্রিয় বাবা ইসমাইল সরদার অকালে মৃত্যুর কুলে ঢলে পড়লেন। তাঁর মা রুমিচা বেগম সহ আরো চার ভাই ও এক আদরের বোনকে নিয়ে বিপাকে পড়েন শফিক। ভাই বোনের মধ্যে পরিবারের বড় হওয়ায় সব দ্বায়িত্ব মাথা পেতে নিতে হয়েছে তাঁর। এত সদস্যে মাঝে কষ্টের পুরো সংসার ইতিবাচক ভাবে তিনিই চালানোর প্রস্তুতি গ্রহন করেছিলেন। ২০০৫ সালে ইন্টার মিডিয়েট পাশের পর তিনি উচ্চ শিক্ষার চিন্তা মাথায় নিয়েছিল। কিন্তু বাবার সামান্য বেতনের চাকরিতে কোন মতে পেটে ভাতে ভালোই চল ছিল। বাবা ছিলেন জুট মিলের সামান্য একজন শ্রমিক, কিছুই সঞ্চয়ে রেখে যেতে পারেননি। বাবার অবর্তমানে উপার্জনের হাল ধরতে হয়েছিল তাঁকে। তাই তো তিনি মায়ের মমতা ছেড়ে গ্রামের বন্ধু বা মনোরম পরিবেশ ভুলে হঠাৎ একদিন পাড়ি দিলেন ঢাকার উদ্দ্যেশে। গার্মেন্টসে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের চাকরিতে মজুরি ছিল অতি সামান্য। যত সামান্য বেতনের প্রাপ্তিটাও তাঁকে অনেক সময় ঝামেলায় ফেলে ছিল। তিনি কিছু দিন এ কষ্টের চাকরি করার পর বিভিন্ন কারণে গার্মেন্টসে থেকে ইতি টানলেন।
তিনি জানালেন, ভাল লাগে না কিছুই শুধু মন পড়ে থাকে শিল্প সংস্কৃতি চর্চায় দিকে। ২০০৮ এ আবার গ্রামে ফিরে এসে কলেজে ভর্তি হলেন। বি, এ পাশ তাঁকে করতেই হবে এমন মনোস্হির তাঁকে অনেক বাস্তবতায় কাটায়। কলেজে কিছু দিন পড়াশুনার পাশাপাশি বিকেলটা যে তাঁর ছিল একাকীত্বে আর অবসবে। তাই তিনি পুনরায় বিভিন্ন চিন্তা চেতনায় সংস্কৃতি চর্চার ভাবটি জাগ্রত করলেন, সেই ভাবটি ছিল যা শৈশোবে। এমন স্হির সিদ্ধান্তে প্রথমত: মৌলিক ভাবনা ছিল ভাস্কর্য এবং আরও পরে শিল্প সংস্কৃতি শাখা প্রশাখায় বিভিন্ন কল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। তিনি বলেন, এ পথে তাঁর আদৌ ছিল না কোনই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। ২০০৮ এ তিনি শুরু করেছিলেন মাটির দ্বারা ভাস্কর্য নির্মাণ। একটার পর একটা চমৎকার ভাস্কর্য নির্মাণ করছিলেন প্রায় দেড় বছর ধরে। তিনি এতো ভাস্কর্য নির্মাণ প্রসংগে বলেন, বিভিন্ন কৃত্তিমান বরেণ্য ব্যক্তিদের স্মরণে এ উদ্দ্যেগ হাতে নিয়েছেন। আশ্চর্য হলেও একথা সত্য যে, ভাস্কর্য পঞ্চাশটিরও বেশি বানাতে সক্ষম ব্যক্তি মাটি, হালকা বালু, পাটের আঁশ ও কাঠ দ্বারা নির্মাণ করতে সাহস পায়। এগুলো ভাস্কর্য দেখার জন্য দুর দুরন্ত থেকে অনেক লোক জন প্রতিদিন দলে দলে ছুটে আসতো দামোদর গ্রামের বাড়িতে মিনি সংগ্রহ শালায়। ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্দ্যেশ্যে তিনি বলেন, দেশ ও জাতির জন্য যাঁরা শহীদ হয়েছেন, যেমন মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, প্রগতিশীল, সুশীল ও আরো অনেক শিহরণ সৃষ্টিকারী লোক যাঁরা ইহলোক ত্যাগ করেছেন, সেসমস্ত ব্যক্তি ও গুনিদের প্রতিনিয়ত এই ভাবে স্মরণে রাখা এবং মানুষ জন যেন দেখে তাঁদের স্মরণ করে রাখেন সেটিই ছিল মুৃল ইচ্ছা। নজরুল ইসলাম তোফাকে তিনি আরও বলেন, এ পন্থায় অগ্রসর হওয়াটা তাঁর একাত্যই নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার আলোকে, আবারও তিনি বলেন, জাতীর স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য এমন উদ্দ্যেগ নয়। সংসার জীবনে আর্থিক অনটন ও প্রতিকুলতার মধ্যে সম্ভব হয়ে ওঠেনি আরও অনেক ভাস্কর্য নির্মাণ। অবশ্য তিনি পরপর দুবার প্রদর্শনীও করেছেন।
যাই হোক, ভাস্কর্য নির্মাণের কথা তিনি শেষ করতে না করতেই শুরু করলেন মিডিয়ার স্বপ্নের কথা। বুকে লালন করা মিডিয়ার চিন্তা ছিল তাঁর গভীর, সে চিন্তার আলোকে নানান প্রতিকুলতার মধ্যেই শুরু করেন নাটক লেখা। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল মিডিয়াতে কাজ করা। লেখা পড়ার ঝামেলায় হয়ে উঠেনি, অবশ্য তিনি বাউবি থেকে কোন মতে বি, এ পাশ করেছেন এবং তিনি জীবন সংগ্রমে মাঝে পেয়ে যান সামান্য একটি চাকরি আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানে। যশোর জেলায় অভয় নগরের নওয়া পাড়ায় কর্মরত আছেন। সেখান থেকে খুলায় ফিরেই শুরু হয় নাটক লেখা। বলতেই হচ্ছে তিনি প্রতিদিন খুলনা জেলার ফুলতলা থানার দামোদর গ্রাম ফিরেন। কারণ বাড়ি না আসলে সংসার দেখা শুনা হয়না।
দামোদর গ্রামের কৃতি সন্তান মিডিয়ার চিন্তা নিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বিটিভির উপস্থাপিকা শায়লা সাবরিন পলির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁরই হাত ধরে তিনি বিটিভির নিজস্ব প্রযোজক শ্রদ্ধেয় নূর আনোয়ার রঞ্জুর সঙ্গে ২০১২ সালে ঈদের জন্য তাঁর লেখা ‘দুই চোর’ নামে একটি নাটক প্রডিউস করেন। পরিচালনায় ছিলেন মাসুদ চৌধূরী। এরপর মিডিয়া ভিশনের শ্রদ্ধেয় মোল্লা ফরিদ আহম্মেদের সহায়তায় শাহাদাৎ আলম ভূবনের পরিচালনায় ‘দশ টাকার লাভ স্টোরী’ নামের আরেকটি নাটক পরিচালনা করেন। এরপর আরোও অনেক গুলো একক নাটক, একটি বায়ান্ন পর্বের দীর্ঘ ধারাবাহিক নাটক, দুইটা টেলিফিল্ম, একটি আর্ট ফিল্ম, তারপর একটি উপন্যাস, অনেক কবিতা ও গানসহ নানা রকমের মজার মজার পান্ডুলিপি তিনি লিখেছেন।
নাট্যকার শরিফুল ইসলাম শরিফের নাট্য তালিকায় রয়েছে একক নাটক ‘দুই চোর’, ‘দশ টাকার লাভ স্টোরি’, ‘হাইব্রিড চিটার’, ‘ঘোড়া রোগ’, ‘সাদা খামে নীল চিঠি’, ‘জীনের বাদশা’, ‘পরের কথায় ঘরে আগুন’, ‘ভালবাসা চাই’, ‘অতি লোভে তাতি নষ্ট’, ‘হৃদয় ভাঙ্গা ডেউ’, ‘কোচিং সেন্টার’, ‘প্রমোশন’, ‘হযবরল’, ‘ইস্মার্ট আনইস্মার্ট’, ‘ভন্ড কবিরাজ’, পারুলের লজিং মাষ্টার’, ‘অবশেষে ভালবাসা’, ‘ইত্যাদি। তিনি নজরুল ইসলাম তোফার গল্প নিয়ে রচনা করেছেন’স্টাইল বয়’। টেলিফিল্মও লিখেছেন দুটি, ‘সুপ্ত মনের বিকাশ লাভ’ ও ‘দুটি মন কাছে টানে’। তাঁর নাটক লেখার গতি যখন অনেক বেড়ে যায় তখনই লিখেছেন দীর্ঘ ধারাবাহিক নাটক ‘চগা দিয়ে বগা বাধানো’। আর্ট ফিল্ম লিখেছেন- ‘এক মুঠো ভাতের জন্য’ এবং একটি উপন্যাস ‘রঙ্গীন প্রজাপতি’। যাইহোক, তিনি নজরুল ইসলাম তোফাকে বলেন, টাকার দুনিয়ায় শুধু টাকা। কথায় আছে না খালি সুতায় গিরে আটেনা। যেখানেই যান সেখানেই চায় শুধু টাকা। কেউ কথা দিয়ে কথা রাখে না। এ পর্যন্ত অনেক প্রতারনার শিকার হয়েছেন তিনি। বর্তমানে অার্থিক নিপীড়নের শিকার হয়ে কোন রকম ভাবে বেঁচে আছেন। তাই ভাল কোন মিডিয়া মাধ্যমের সহায়তা পেলে পুরনো সেই নাটক লেখার অভ্যাস পুনরায় চালু করতে পারেন খুব ভালো ভাবে। সংসারের অনেক অভাবের মাঝেও প্রতিভাকে কখনও গলা টিপে শেষ করতে চাননা তিনি। সকল মানুষের যেন প্রতিভার দ্বার জাগ্রত হয় এ আশাও ব্যক্ত করেন।