ফুটবল খেলোয়াড়দের বিষয়ে মন্তব্যের জেরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে আমেরিকায়। বিশেষত ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে ট্রাম্পকে। এক কথায় সবাই ট্রাম্পের এ বক্তব্যকে ‘বিভেদমূলক’ ও ‘বর্ণবাদী’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। অনেকে একে দেখছেন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার স্মারক হিসেবে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি জমায়েতে বক্তব্য দেওয়ার সময় খেলোয়াড়দের নিয়ে বেশ কিছু বিস্ফোরক মন্তব্য করেন ট্রাম্প। এতে তিনি বলেন, ‘মাঠে জাতীয় সংগীত চলাকালে কোনো ঘটনার প্রতিবাদ জানানো খেলোয়াড়দের জাতীয় ফুটবল লীগ (এনএফএল) থেকে বরখাস্ত করা উচিত।’ এ সময় তিনি গত বছর এনএফএলের এক খেলায় জাতীয় সংগীত সময় কলিন কেপারনিকের হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ জানানোর ঘটনার কথা উল্লেখ করেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, “জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করা কোনো খেলোয়াড়কে যখন এনএফএলের কোনো দলের মালিক ‘বের হয়ে যাও কুকুরের বাচ্চা’ বলে বরখাস্ত করে, তখন আপনাদের কি তা ভালো লাগে না?’ এখানেই থামেননি তিনি। সমর্থকদের তিনি এনএফএল বর্জনেরও আহ্বান জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে ট্রাম্পের এসব বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। দেশটির শীর্ষ ফুটবল খেলোয়াড়রা প্রেসিডেন্টের এ মন্তব্যকে ‘বিভেদ সৃষ্টিকারী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এক বিবৃতিতে এনএফএলের কমিশনার রজার গুডেল বলেন, ‘এ ধরনের বিভেদমূলক বক্তব্য অন্যের প্রতি অসম্মানের মানসিকতার স্মারক, যা দুর্ভাগ্যজনক।’ একই ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এনএফএল-এ অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের সংগঠন। সংগঠনটির মতে, এ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট সীমা অতিক্রম করেছেন। অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এরিক উইনস্টন বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের এ মন্তব্য অতীত ও বর্তমানের সব নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নায়কদের মুখে একটি চপেটাঘাতের মতো।’
এদিকে সমর্থকদের জমায়েতে দেওয়া বক্তব্যেই থেমে থাকেননি ট্রাম্প। ২৩ সেপ্টেম্বর নিজের টুইটার পোস্টে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জাতীয় বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এনবিএ) আরেক সুপারস্টার স্টেফ কারিকে নিয়েও বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। ওই দিন দেওয়া টুইটার পোস্টে ট্রাম্প বলেন, হোয়াইট হাউসের আমন্ত্রণ যে কারও জন্যই গর্বের বিষয়। অথচ সে (স্টেফ কারি) এটি নিয়ে দোনোমনা করছে। তাঁর আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করা হলো।’
এর প্রতিক্রিয়ায় গোল্ডেন স্টেট ওয়ারিয়রস হোয়াইট হাউসের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দলের সদস্যরা নির্ধারিত দিনে ওয়াশিংটনে যাবে। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের বদলে তারা বৈচিত্র্য ও সমন্বয় বিষয়ে আয়োজিত একটি ইভেন্টে যোগ দেবে। এর পর ট্রাম্প আরও দুটি টুইট করেছেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল এনএফএল খেলোয়াড়েরা। টুইটার পোস্টে তিনি বলেন, ‘এনএফএল কিংবা অন্য কোনো লিগে যোগ দিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয়ের সুবিধা পাওয়ার পরও কোনো খেলোয়াড়কে আমাদের মহান আমেরিকান পতাকা (এবং দেশকে) অসম্মান করার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। এদের সবার উচিত জাতীয় সংগীতের সময় উঠে সম্মান জানানো। আর তা না হলে তাঁদের বরখাস্ত করা উচিত।’
ট্রাম্পের বক্তব্যকে বিভেদমূলক বলার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যে দুজন খেলোয়াড়ের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন দুজনই কৃষ্ণাঙ্গ। এর মধ্যে কলিন কেপারনিক কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে আমেরিকার আচরণকে তুলে ধরতেই জাতীয় সংগীতের সময় দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানান। এটি ছিল তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। পরে তাঁর দল সানফ্রান্সিসকো ফোরটিনাইনারস তাঁকে বরখাস্ত করে। এখন পর্যন্ত অন্য কোনো দল তাঁকে নেয়নি।
সিএনএনের এডিটর অ্যাট লার্জ ক্রিস সিল্লিজ্জা বলেন, ‘এনএফএল ও এনবিএ উভয় লিগের অধিকাংশ খেলোয়াড় কৃষ্ণাঙ্গ। এর বিপরীতে এ দুই লিগে থাকা দলগুলোর অধিকাংশের মালিক শ্বেতাঙ্গ। এনএফএলের কোনো দলের মালিক কৃষ্ণাঙ্গ নন। আর এনবিএতে একটি দলই কৃষ্ণাঙ্গ মালিকানায় রয়েছে, আর তা মাইকেল জর্ডানের। দুই দিনে ট্রাম্পের করা একাধিক মন্তব্যের গুরুত্ব বুঝতে এ পরিসংখ্যানটিই যথেষ্ট। আর আমেরিকার রয়েছে দাস সমাজের ইতিহাস। সব বর্ণের মানুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা এখনো আমাদের লক্ষ্য, অর্জন নয়। এ ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে কোনো কিছু করা, স্বেচ্ছা অন্ধত্বেরই পরিচায়ক।’
ক্রিস সিল্লিজ্জা বলেন, ‘এনএফএল নিয়ে দেওয়া বক্তব্যে ট্রাম্প মার্কিন ঐতিহ্যকে যুক্ত করেছেন। পরে এ বিষয়ে দেওয়া দুই টুইটে তিনি এনএফএল ও এনবিএতে খেলতে পারাকে বিশেষ সুবিধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এটা যেন এমন তোমরা যা পাচ্ছ, তা নিয়েই কৃতজ্ঞ থাক। তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট, যাও খেল, কিন্তু কোনো সমস্যা কোরো না। এমনকি একটি বর্ণান্ধ সমাজের জন্যও এমন মনোভাব ভয়ানক। কারণ সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতেই মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর আমাদের সাহসী যোদ্ধারা জাতীয় সংগীতের সময় কেউ দাঁড়াবে, এ জন্য যুদ্ধ করেননি। বরং সবাই যেন দ্বিধাহীনভাবে নিজের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ করতে পারে, সে অধিকারের জন্যই যুদ্ধ করেছিলেন তাঁরা।’