খোলাফায়ে রাশেদিন এর পর ইসলামিক ভূখণ্ডগুলোর বিশাল অংশ শাসিত হয়েছে তিনটি খিলাফত দ্বারা।এগুলো হলো উমাইয়া, আব্বাসিয়া এবং ওটোমান(উসমানিয়া)।এর মধ্যে শেষ খিলাফত ওটোমান এর ব্যাপতিকাল ছিলো ১২৯৯ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত। পূর্ব ইউরোপ,রাশিয়ার কিছু অংশ, মরক্কো থেকে ইরাক পর্যন্ত ভূখণ্ড এই খিলাফত দ্বারা শাসিত হয়েছে যার রাজধানী ছিলো তুরস্কের ইস্তাম্বুল।এই ওটোমান খিলাফতের একজন পরাক্রমশালী বাদশাহ ছিলো সুলতান সুলাইমান(১৫২০-১৫৬৬)যার কাহিনী বাংলাদেশে একটি টিভি সিরিয়াল এর মাধ্যমে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।ইতিহাসে সুলতান সুলাইমান এর নাম সবসময় স্মরণ করা হয় সাহসী যোদ্ধা হিসেবে বিশাল রাজ্য শাসনে উসামান্য দক্ষতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত প্রয়োগ এর জন্য।তার তেমন একটি নিষ্ঠুর এবং ভূল সিদ্ধান্তর বলী হয়েছিলো তার আপন সন্তান মুস্তাফা।সুলতান সুলাইমানের দুই পত্নী হুররেম এবং মাহিদেভরান মিলে সুলাইমানের ছয় পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, যাদের মধ্যে ৪ জন ১৫৫০ সালের মধ্যে জীবিত ছিল: মুস্তফা, সেলিম, বায়েজিদ, ও জাহাঙ্গীর। এদের মাঝে, মুস্তাফা ছিল বয়োজ্যেষ্ঠ উত্তরাধিকারী হিসেবে হুররেমের সন্তানের অগ্রবর্তী ছিলেন।
মুস্তফাও সকল ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বিচক্ষণ বলে অনেকেই তাকে প্রাধান্য দিত এবং পারগালি ইব্রাহীম পাশাও তাকে সমর্থন করতেন, যিনি ১৫২৩ সালে সুলতানের প্রধান উজির হন। অনেক তথ্যসূত্রে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ইব্রাহিম পাশা হুররেম সুলতানের চক্রান্ত ও প্রাসাদে তার উঠতি প্রভাবের একজন ভুক্তভোগী ছিলেন, বিশেষ করে অতীতে শাহজাদা মুস্তফাকে সমর্থন করার কারণে, হুররেমের প্ররোচনায় পরিচালিত ক্ষমতার লড়াইয়ে, সুলাইমান ১৫৩৬ সালে ইব্রাহিমকে খুন করেন এবং তার তার কন্যা মিহিরমার স্বামী ও তার স্নেহভাজন জামাতা রুস্তম পাশাকে (প্রধান উজির ১৫৪৪-১৫৫৩ এবং ১৫৫৫-১৫৬১) হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করেন।
রুস্তম পাশা ও হুররেম সুলতান উভয়ই সুলায়মানকে মুস্তফার বিরুদ্ধে উসকিয়ে দেন এবং মুস্তফাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। ঐতিহাসিক সূত্র দ্বারা জানা যায় ১৫৫৩ সালে সফভীয় ইরানের বিরুদ্ধে অভিযানকালে, রুস্তম পাশা সুলায়মানকে অবহিত করেন মুস্তাফা বিদ্রোহ করেছেন এবং সুলাইমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে সৈনাবাহিনীর একটি অংশ নিয়ে এগিয়ে আসছেন।এই পরিস্থিতিতে সুলতান সুলায়মান মুস্তাফার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। বিপরীতে মুস্তাফাকে বলা হয় ইরানের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য সুলতান সুলায়মান মুস্তাফার সহায়তা চেয়েছেন ,যার পরিনতিতে মুস্তাফা সৈন্যবাহিনী নিয়ে সুলতান সুলায়মানকে সাহায্য করার জন্য রওনা দেন।এরপর মুস্তাফা সুলতান সুলায়মানের তাবুতে প্রবেশ করলে সুলতান সুলায়মানের দেহরক্ষীরা তাকে আক্রমণ এবং হত্যা করেন। কথিত আছে যে, জাহাঙ্গীর, হুররেমের কনিষ্ঠ সন্তান, তার সৎ-ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে বেদনাকাতর হয়ে কয়েক মাস পরেই মারা যান।১৫৫৩ সালে সুলায়মান মুস্তাফাকে প্রাণদণ্ড দেয়ার পর, সৈন্যদের মধ্যে একটি বড়মাপের অসন্তুষ্টি ও অস্থিরতার উত্থান হয় যারা রুস্তম পাশাকে মুস্তফার মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন। এ ঘটনায় সুলায়মান রুস্তম পাশাকে বরখাস্ত করেন এবং ১৫৫৩ সালে কারা আহমেদ পাশাকে প্রধান উজির হিসেবে নিয়োগ দেন।
কিন্তু সবে দুই বছর পর, কারা আহমেদ পাশাও হুররেম সুলতানের নোংরা চক্রান্তের স্বীকার হন, কারণ হুররেম তার জামাতা রুস্তম পাশাকেই আবারও প্রধান উজির হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ১৫৫৫ সালে কারা আহমেদ পাশাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় এবং রুস্তম পাশাকে আরও একবার প্রধান উজির (১৫৫৫-১৫৬১) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। 1566 সালে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সময় সুলতান সুলাইমান অসুস্থ হয়ে নিজ তাবুতে মৃত্যু বরন করেন এরপর হুররেমের পুত্র দ্বিতীয় সেলিম সুলতান হন। ১৫৬১ সালে, হুররেমের মৃত্যুর তিন বছর পর,ফরাসি লেখক গ্যাব্রিয়েল বোনিন মুস্তাফার মৃত্যুতে হুররেম সুলতানের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে লা সুলতানেনামে একটি ট্র্যাজেডি নাটিকা লেখেন। তুরস্কের বিভিন্ন লোক কাহিনীতে মুস্তাফাকে আজও সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়।