কলামিস্টঃ আর.এম।।
প্রায়ই আমাদের রাজনীতিতে ক্রসফায়ার নিয়ে ঝড় ওঠে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা ক্রসফায়ার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এটা বন্ধের দাবি ও আবেদন-নিবেদন করে থাকেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি থাকে ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে। আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগের অপছন্দের বিষয় হয় ক্রসফায়ার। সাভারের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান সম্প্রতি ক্রসফায়ার নিয়ে একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়ে ছোটখাট বোমা ফাটিয়েছেন। ১৯ জুলাই দৈনিক মানবজমিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমপি সাহেব বলেছেন:
“৫ জনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছি, আরও ১৪ জনের লিস্ট করেছি। সব ঠাণ্ডা। লিস্ট করার পর যে দুয়েকজন ছিল, তারা আমার পা ধরে বলেছে, ‘আমাকে জানে মাইরেন না, আমারা ভালো হয়ে যাব’।”
একজন সংসদ সদস্যের এমন প্রকাশ্য বক্তব্যে যেমন প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা তেমনই হয়েছে। সাভারে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এমপি সাহেব যে ১৪ জনের লিস্ট করছেন, তার মধ্যেকার কার নাম আছে তা নিয়ে আগ্রহ-কৌতূহল-উদ্বেগ-ভয় একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও জিজ্ঞাসা তৈরি হয়, এরপর তাহলে কার পালা? কে যাচ্ছে ক্রসফায়ারে?
সত্যটা গণমাধ্যমে বলার পর এমপি সাহেব অবশ্য তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। হয়তো দলের ওপরমহল থেকেই তাকে এমন বক্তব্য দেওয়ার জন্য ভৎর্সনা করা হয়েছে অথবা তার নিজেরই বোধোদয় হয়েছে যে, গোপনে যে কাজ করা হয়, প্রকাশ্যে তা বলা যায় না। বললে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
ডা. এনামুর রীতি ভেঙে গোপন কথা ফাঁস করে এখন নিজেই ফেঁসে গেছেন। বাধ্য হয়েছেন বক্তব্য প্রত্যাহার করতে। তবে অন্যদের মতো বেকায়দায় পড়ে বলেননি যে, তিনি অমন কথা বলেননি কিংবা পত্রিকায় তার বক্তব্য বিকৃত করে ছাপা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, তিনি ঘোড়েল পলিটিশিয়ান হয়ে উঠতে পারেননি।
আওয়ামী লীগ তাকে শো-কজ করেছে। তিনি কিছু একটা জবাব হয়তো দেবেন। তার জবাবে খুশি হওয়া না-হওয়া আওয়ামী লীগের ব্যাপার। তিনি যদি দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে সর্বোচ্চ শাস্তি হবে দল থেকে বহিষ্কার অথবা আগামী নির্বাচনে তাকে নমিনেশন থেকে বঞ্চিত করা। কিন্তু এতে একদিকে যেমন ৫ জন মানুষকে হত্যার অপরাধের বিচার হয় না, অন্যদিকে তার কারণে সরকারের যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হলো তারও প্রতিকার হয় না।
তিনি যে ৫ জনকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার কথা নিজে স্বীকার করেছেন, তারা দোষী না নির্দোষ আমরা তা জানি না। যদি ধরেও নিই যে, তারা সবাই চিহ্নিত সন্ত্রাসী বা অপরাধী ছিল তাহলেও কিন্তু ডা. এনামুর আইনের আওতার বাইরে যেতে পারেন না। কাউকে বিনা বিচারে শাস্তি কেউ দিতে পারেন না।
কোনো বিচারক কি ইচ্ছে করলেই কাউকে শাস্তি দিতে পারেন? আইনের চোখে অপরাধী সাব্যস্ত হলেই কেবল কাউকে শাস্তি দেওয়া যায়, অন্যথায় নয়। ডা. এনামুর অজ্ঞ বা আইন না-জানা সাধারণ মানুষ নন। তিনি নিজে একজন আইনপ্রণেতা। কাজেই জেনেবুঝে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজসে কয়েকজনকে ক্রসফায়ারে দিয়েছেন, আরও কয়েক জনকে তালিকাভুক্ত করেছেন। এরা অপরাধী হতে পারে আবার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও হতে পারে। তবে কোনোভাবেই এটা সাধারণ ঘটনা নয়। এটি যদি উপেক্ষিত হয় তাহলে বিনা বিচারে হত্যার প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার গল্প আমাদের শৃঙ্খলাবাহিনী প্রায়ই প্রচার করে থাকে, যার কোনোটাই সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না। মানুষ মনে করে, শৃঙ্খলাবাহিনী তাদের হেফাজতে থাকা একজনকে মেরে ফেলে তারপর ক্রসফায়ার অথবা বন্দুকযুদ্ধের কথা বলে। এই অভিযোগও নতুন নয় যে, সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা ও সংসদ সদস্যরা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কখনও কখনও জড়িয়ে যান অথবা শৃঙ্খলাবাহিনীও কখনও কখনও ঢাল হিসেবে সরকারি দলের প্রভাবশালীদের ব্যবহার করে। তারা পরস্পরের স্বার্থের পাহারাদার হয়ে যায়।
ক্রসফায়ার বর্তমান সরকারের আমলে শুরু হয়েছে ব্যাপারটি মোটেও তেমন নয়। এটা বিএনপি সরকারের সময় থেকে শুরু হয়ে এখনও অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে অঙ্গীকার করেছিল যে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা ক্রসফায়ার বন্ধ করবে। কিন্তু ক্ষমতায় এসে অঙ্গীকাররক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে তারা। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধে প্রাণনাশ চলছেই।
ক্রসফায়ার কিংবা বন্দুকযুদ্ধে মাঝে-মধ্যে প্রকৃত সন্ত্রাসী বা অপরাধী মারা যায় না, তা-ও নয়। এ রকম কেউ মারা গেলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সাময়িক স্বস্তি দেখা যায় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উৎসাহ বোধ করে থাকে। কিন্তু বিনা বিচার হত্যা যে অপরাধ দমনের কার্যকর বা আইনসম্মত কোনো পথ নয়-– এটাও সংশ্লিষ্ট সবাই জোর দিয়েই বলে থাকেন। আইনের যথাযথ প্রয়োগ, আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করা, পুলিশকে দক্ষ এবং একইসঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত করা না গেলে সমাজ অপরাধমুক্ত করা যাবে না