জুন মাসে দেশে স্বাভাবিক যে তাপমাত্রা থাকার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি তাপে অতিষ্ঠ ছিল সাধারণ মানুষ। জুলাই মাসের শুরুতেও ছিল না বৃষ্টির দেখা। আবার জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে টানা ৮-৯ দিন যাবত বৃষ্টিতে নগর-বন্দর পানিতে টুইটুম্বুর। চলতি মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। এই পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বৃষ্টিপাতের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়া বিভাগের হিসাব বলছে, এই জুলাইয়ে দেশের সর্বত্র স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। এ মাসে চট্টগ্রাম বিভাগে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ৫৫৬ মিলিমিটার, অথচ মাসের ৫ দিন বাকি থাকতেই বৃষ্টিপাত হাজার মিলিমিটার ছাড়িয়েছে। যার কারণে চট্টগ্রাম এখন পানির নিচে অনেকটাই তলিয়ে গেছে। সিলেট বিভাগে জুলাই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ৪৫৬ মিলিমিটার। অথচ মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে ইতোমধ্যে বৃষ্টিপাত হাজার মিলিমিটার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে জুলাইয়ে বৃষ্টিপাতের এই চিত্র স্বাভাবিক নয়। তবে কয়েক বছর ধরে এমনটাই হচ্ছে।
এখন শুধু যে একেক সময় একেক অঞ্চলে বৃষ্টি হয়, তা নয়। জুলাইয়ে যে রকম বৃষ্টি হওয়ার কথা, তা হয়তো হচ্ছে সেপ্টেম্বরে। হয়তো জুনের শুরুতে প্রচণ্ড তাপ পরক্ষণেই আবার টানা বৃষ্টি। তারপর একটানা সাত দিন কিংবা ১০ দিন একেবারে বৃষ্টিহীন, খড়খড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার আগাম অতিবৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়ার এমন খামখেয়ালি আগামী দিনে আরও বাড়বে। দেশে আবহাওয়ার যে নিয়মতান্ত্রিকতা ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেটি ভেঙে পড়েছে। কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণ কমাচ্ছে না, বরং বাড়াচ্ছে। তাদের ভোগ-বিলাসের বলি হচ্ছে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিনিয়তই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। এ কারণে দুই মেরুতে জমাট বরফ গলতে থাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এর প্রভাবে আগে যেসব জায়গায় জোয়ারের পানি উঠত না, সেসব অঞ্চল এখন প্লাবিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম তার ভুক্তভোগী।
বৃষ্টিপাতের ধরনে এই যে পরিবর্তন তার সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশের কৃষক। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জসহ হাওরাঞ্চলের মানুষ বছরের পর বছর ধরে দেখে আসছে, এপ্রিলের শেষ কিংবা মের প্রথম সপ্তাহে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল নামে। কৃষকদের প্রস্তুতিও থাকে ওই সময়কে ধরে। অথচ এবার মার্চের শেষের দিকে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বোরোর কাঁচা ধান তলিয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দেশের শতাধিক স্থানে পানির স্তরের পাশাপাশি বৃষ্টিপাতের পরিমাণও পরিমাপ করে। পাউবোর মতে বৃষ্টিপাতের ধরন আর আগের মতো নেই। যখন যতটা হওয়ার কথা তখন ততটা হয় না। অল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়। বাকি সময় থাকে বৃষ্টিহীন।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘বৃষ্টিপাতের ধরন বদলাচ্ছে। এখন পর্যন্ত এটা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে বলে অনেকে সেটা বলতে দ্বিধা করছেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে এটা আরও বদলাবে। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারের নীতিনির্ধারক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা সবার জানা জরুরি। কিন্তু কতজন বিষয়টি জানেন?’
তবে আবহাওয়া অধিদফতরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ ছাদেকুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো কোনো বছর বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিকতায় কিছুটা ব্যত্যয় ঘটে। এমনকি, একটানা দু-তিন বছরও এটা হতে দেখা যায়। আবহাওয়ার দীর্ঘ ৫০-৬০ বছরের যে তথ্য অধিদফতরে সংরক্ষিত, সেখানে এমন ঘটনা অনেকবার ঘটার তথ্য পাওয়া যায়। তাই এটাই বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাওয়ার নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা যায় না।’