গত বছরের তুলনায় এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ কমেছে। একই সঙ্গে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ২০ হাজার ৩০৭ জন।
এ ছাড়া এবার ফলের অন্যান্য সূচকেও নেতিবাচক ধারা দেখা গেছে। গত বছরের তুলনায় শতভাগ পাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ৩১৬টি, সঙ্গে সব শিক্ষার্থী ফেল করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৭টি বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি, কুমিল্লা বোর্ডের পাসের হার ৫০ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়া এবং বেশির ভাগ বোর্ডের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের পাসের হারে ধস নামার কারণে মূলত এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে।
পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতির কারণে ফলাফল গত বছরের তুলনায় খারাপ হতে পারে, এজন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
শিক্ষামন্ত্রী রবিবার (২৩ জুলাই) দুপুরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন।
এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় দশ বোর্ডে গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। গত বছর গড় পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। এবার পাসের হার ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ কমেছে।
মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৫৮ হাজার ২৭৬ জন। গত বছরের চেয়ে এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী কমেছে ২০ হাজার ৩০৭ জন।
চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রথম উত্তরপত্র মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতি চালু করা হয়। এজন্য এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ হাজার কমেছে বলেও জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী।
উত্তরপত্র মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা দেখেছি আমাদের পরীক্ষকরা ঠিক মতো খাতা দেখেন না। খাতা না দেখায় শিক্ষার্থীদের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন হচ্ছে, কোন কোন ক্ষেত্রে অতিমূল্যায়ন হচ্ছে। কেউ বেশি নম্বর পেয়ে যাচ্ছে, কেউ কম নম্বর পাচ্ছে। কেউ হাস্যচ্ছলে বলে খাতা ওজন করে নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়।’
উত্তরপত্র মূল্যায়নের সঠিক পদ্ধতি বের করতে বাংলাদেশ শিক্ষা উন্নয়ন ইউনিটকে (বেডু) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে নাহিদ বলেন, ‘সেই অনুযায়ী গত বছর আমরা নতুন ব্যবস্থাটা গ্রহণ করি। (নতুন মূল্যায় পদ্ধতিতে) প্রত্যেক পরীক্ষক খাতা মূল্যায়নের পর এর সাড়ে ১২ শতাংশ পরীক্ষা করে দেখা হবে তিনি ঠিক মত মূল্যায়ন করেছেন কিনা। প্রধান পরীক্ষক যে খাতা দেখেছেন সেটাও আমরা মূল্যায়ন করব।’
মন্ত্রী আরও জানান, এই পদ্ধতিতে প্রশ্নের একটি সাধারণ উত্তরও প্রস্তুত করে পরীক্ষকদের দেওয়া হয়ভ। এটাকে মানদণ্ড ধরে শিক্ষকরা নম্বর দিয়ে থাকেন।
নতুন পদ্ধতি চালুর পর শিক্ষকরা ভীত ছিলেন যে খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করলে যেন কোনো সময় ধরা পড়তে পারেন বলেও জানান তিনি।
নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘পরীক্ষা করে দেখা গেছে একই খাতা ২০ কপি করে ২০ জন শিক্ষকের কাছে দেওয়া হয়। দেখা গেছে ২০ জন ২০ রকম নম্বর দিয়েছে। এগুলোকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে আমাদের ৪ বছর কাজ করতে হয়েছে। গত এসএসসি পরীক্ষায় আমরা এটা প্রয়োগ করি। সেখানে দেখা গেছে গত বছরের তুলনায় এবার ৮ শতাংশ বেশি ফেল করেছে।’
‘অনেকে বিস্মত হতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ের আমরা প্রস্তুত ছিলাম। এই যে ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে (ফলাফল) এ ধরণের পরিবর্তন হতে পারে। বেশি বা কম পাস করানো নয়, সঠিক মূল্যায়ন করে শিক্ষার্থীকে এগিয়ে নেওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য।’
এবার এসএসসিতে আট বোর্ডের মধ্যে কুমিল্লা বোর্ডে পাসের হারে ধস নেমেছে। এই বোর্ডে এবার অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। এ বোর্ডে এক লাখ ৩৭২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ৪৯ হাজার ৭০৪ জন।
কুমিল্লা বোর্ডে এবার পাসের হার সবেচেয়ে কম, ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। গত বছর পাসের হার ছিল ৬৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ বছর পাসের হার ১৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ কমে গেছে।
ফলাফলের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কুমিল্লা বোর্ডে গত বছর এক হাজার ৯১২ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেলেও এবার পেয়েছে মাত্র ৬৭৮ জন। এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজার ২৩৪ জন কমেছে।
কুমিল্লা বোর্ডের ফল বিপর্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘কুমিল্লা বোর্ডে বড় বিপর্যয় হয়েছে, এটা আমাদের আরেকটু মূল্যায়ন করে খতিয়ে দেখে তারপর বলাটা যথাযথ হবে। এখন একটা স্পন্টনিয়াস উত্তর দিয়ে দিলাম, এটা খুব সঠিক হবে না। আরও তথ্য নিয়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করে আপনাদের জানাব। এটা আমাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে, কেন এটা হল?’
এ ছাড়া এবার বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের মধ্যে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের ফলাফল বেশি খারাপ হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানে ৮৩ দশমিক ১৪ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষায় ৬৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ পাস করেছে। কিন্তু মানবিকে পাস করেছে ৫৮ দশমিক ১৪ শতাংশ।
ফলের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কুমিল্লা বোর্ডে এবার মানবিকে ৩৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর এ হার ছিল ৬৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
এবার মানবিকে চট্টগ্রাম বোর্ডে ৪৭ দশমিক ৪৯, ঢাকা বোর্ডে ৫৬ দমমিক ৫৯, রাজশাহী বোর্ডে ৬৩ দশমিক ১৬, যশোর বোর্ডে ৬৩ দশমিক ৯৩, বরিশালে ৬৩ দশমিক ৭৩, সিলেট বোর্ডে ৬৭ দশমিক ৮২ এবং দিনাজপুর বোর্ডে ৬০ দশমিক ২৩ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে।
পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রী বলেন, ‘পরীক্ষায় একবার পাস-ফেল করার মধ্যেই জীবন শেষ নয়। অনেক সময় এটা নানা কারণেই ঘটতে পারে। তাই যারা উত্তীর্ণ হতে পারেননি তাদের আহ্বান জানাব, আগামীবার আবার পরীক্ষা দেবেন ও উত্তীর্ণ হবেন। এই মানসিকতা নিয়ে যেন তারা ফলাফল গ্রহণ করেন।’