সিদ্দিকুর রহমান ॥
সর্বস্তরের গনমানুষের অংশগ্রহনে ‘বরিশাল ফুল সরণি’ বিনির্মাণে বরিশালে আরো একটি ইতিহাস রচিত হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে সারা বাংলাদেশের মধ্যে এই প্রথম পরিবেশবান্ধব বৃক্ষরোপন কর্মসূচিতে এত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনে মহাসড়কটি জনসমুদ্রে পরিনত হয়েছে। বৃক্ষরোপন কর্মসূচিতে অংশগ্রহন করা শিশু থেকে বৃদ্ধবয়সী সকলের মধ্যেই যেন সাজ সাজ রব পড়ে যায়। জেলা প্রশাসন পরিচালিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বরিশাল সমস্যা ও সম্ভাবনা ফেসবুক গ্রুপের সদস্য জাহিদ চয়নের আহবান এবং জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামানের উদ্যোগের ফলেই এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। আরো একটি ইতিহাস রচনা করেছে সাধারন জনগন। আর এইসব কার্যক্রম সফলে জনসাধারনের ঐক্যবদ্ধতা ও স্বতঃস্ফুত অংশগ্রহনের যে বিকল্প নেই সেটা আবারো প্রমান করে দিয়েছে।
তাছাড়া বরিশাল-ভোলা মহাসড়কের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ফুল সরণি নির্মাণ উৎসবকে ঘিরে জেলা প্রশাসনের প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছিল অক্লান্ত পরিশ্রম। কর্মসূচিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় মোড় (হিরন পয়েন্ট) থেকে চরকাউয়া জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ৪.৮ কিলোমিটার সড়কে কৃষ্ণচূড়া, সোনালু ও জারুল গাছের তিন হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে। আর এই চারা আনা হয়েছে সাভার থেকে। তাই ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই বরিশালের ইতিহাসে যোগ হলো আরো একটি স্মরনীয় দিন। স্থানীয় নামী-দামী শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশনা, বিভিন্ন কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের বাদক দলের নৈপুন্যতা প্রদর্শনের ফলে বৃক্ষরোপন কর্মসূচিতে সবার ক্লান্তিই দূর হয়ে যায়। স্ব-স্ব উদ্যোগেই বৃক্ষরোপন কাজগুলো সম্পন্ন করেছে। আর যাদের অবদানের জন্য আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশ, সেই বীর সৈনিকদের অংশগ্রহন যেন তরুন প্রজন্মকে আরো অনুপ্রানিত ও উজ্জীবিত করেছে।
৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়কটিতে ১০০ মিটার করে ৪৮টি খ- ভাগ করে সেখানে চারা রোপণের জন্য ৩ টি ব্লকে ৪৮টি দল বিভক্ত করা হয়েছিল। এছাড়াও প্রতিটি ব্লকে একটি প্যান্ডেল, সম্প্রচার দল, প্রতিষ্ঠান সাংস্কৃতিক দল, মেডিকেল টিম, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সিটিজেন জার্নালিস্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষাথীবৃন্দ অংশগ্রহন করেন। আনন্দ উল্লাস এবং নেঁচে গেয়ে বৃক্ষরোপন কর্মসূচির উৎসবকে বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করেছেন সকলেই। আর এইসকল কর্মযঙ্গের মধ্যমনি ছিলেন জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান। ঐ সময়ে উৎসবটিকে ঘিরে তার প্রতিটি বক্তব্য প্রতিটি মানুষকে এই কাজে আরো অনুপ্রানিত করেছে।
গতকাল শনিবার সকাল ১০টা থেকে পৃথক ভাবে ৩টি ব্লকেই জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামানের সভাপতিত্বে ফুল সরণি বিনির্মানে বৃক্ষরোপন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন বিভাগীয় কমিশনার মো. শহিদুজ্জামান। ফুল সরণির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিভাগীয় কমিশনার মো. শহিদুজ্জামান বলেছেন, জনগনের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহনই পারে এই রকম মহতী উদ্যোগ সফল করতে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রহন করা এই উদ্যোগ আর সর্বসাধারনের উপস্থিতি সারা বাংলাদেশেই একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, শুধু বৃক্ষরোপন করেই নয়, এর রক্ষনাবেক্ষনের দ্বায়িত্ব আমাদের সকলের। তাছাড়া বর্তমান সরকারের সফল উদ্যোগে যে জনবান্ধব কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হচ্ছে তার উদাহরন এই বৃক্ষরোপন কর্মসূচি। এসময় তিনি এই কর্মসূচির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করেন। এদিকে জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান বলেছেন, বৃক্ষরোপন যে উৎসব হতে পারে বরিশালবাসী তা প্রমান করে দিয়েছে। এর আগেও সম্মিলিত গনজাগরনের মধ্যে দিয়ে উৎসবের মাধ্যমে কাজ করা যায় তা বরিশাল নগরীর ঐতিহ্যবাহী জেল খালসহ ২৩ টি খাল উদ্ধারে প্রমান করে দিয়েছেন তারা। এজন্য তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। জারুল, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া রোপনের মধ্যে দিয়ে পরিবেশবান্ধব বরিশাল নগরী, তথা পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ রুপান্তরিত হবে। তিনি আরো বলেন, পরিবেশ বান্ধব নগরী বা জেলা তৈরিতে জনসাধারন, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দদের অংশগ্রহন বাংলাদেশের ইতিহাসে উদাহরন হয়ে থাকবে। এছাড়াও এই উৎসবকে ঘিরে আগামী দিনের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়নের সাফল্য অর্জন করবে। এসময় তিনি এই রোপিত বৃক্ষগুলোর রক্ষনাবেক্ষনের বিষয়ে বলেন, এই ৫ কিলোমিটারের মহাসড়কে বন বিভাগের দ্বায়িত্বরত ১৮ জন কর্মী এই বৃক্ষগুলোর রক্ষণাবেক্ষন করবে। পাশাপাশি দ্বায়িত্ব বোধ এবং সচেতনতার মধ্যে দিয়ে সকলে মিলে এই গাছ গুলোর রক্ষনাবেক্ষন করা হবে। এছাড়াও এই বৃক্ষরোপন কর্মসূচিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ অংশগ্রহন করেছে। পরে অনুষ্ঠানে সকলকে শপথবাক্য পাঠ করান জেলা প্রশাসক।
এসময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু, স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. জাকির হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো, আহসান হাবিব, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. আবুল কালাম তালুকদার, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. মনির হোসেন হাওলাদার, প্যানেল মেয়র কেএম শহীদুল্লাহ, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির, বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো, জয়নুল আবেদিন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাজমুল হোসাইন খান, চরকাউয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ছবি, চাদঁপুরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. আমানউল্লাহ আমান, জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রমেন্দ্র নাথ বাড়ৈ, জেলা প্রাানি সম্পদ কর্মকর্তা ড. একরামুল করীম চৌধুরি, বরিশাল আঞ্চলিক শিক্ষক সমিতির উপদেষ্টা দাশগুপ্ত আশীষ কুমার, সভাপতি অধ্যক্ষ ফরিদুল আলম জাহাঙ্গীর, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোকলেছুর রহমান, দৈনিক আজকের পরিবর্তন ও দৈনিক কীর্তনখোলা পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক কাজী মিরাজ মাহমুদ, নির্বাহী সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, কে এস মহিউদ্দিন মানিক বীর প্রতিক, সরকারি বিএম কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক স ম ইমানুল হাকিম, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরি, এনজিও প্রতিনিধি কাজী জাহাঙ্গীর কবির, নির্বাহী হাকিম সুখময় সরকার, উর্মি ভৌমিক, নাহিদুল করিম, আহসান মাহমুদ রাসেল, রিপন বিশ^াস, মাহমুদা আক্তার, লুৎফুন্নেছা খানম, মেহনাজ ফেরদৌস, এস এম রবীন শীষ, মাহমুদা কুলসুম মনি, তাহমিনা আক্তার, মো. আসাদুজ্জামান, মো. রেজাউল করিম, দিলরুবা ইসলাম, মহিলা পরিষদের নেত্রী নুরজাহান বেগম, শাহ সাজেদা, নিগার সুলতানা হনুফাসহ প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ, এনজিও প্রতিনিধিবৃন্দ, ইউনিয়নের ইউপি সদস্যবৃন্দ।
এদিকে বৃক্ষরোপন উৎসবকে কেন্দ্র করে সকাল ৮টা থেকে মহাসড়কের নির্দিষ্ট স্থানে ভিড় করে জনসাধারন। এছাড়াও নগরীর সাধারন মানুষদের এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহনের জন্য নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যান থেকে ১০টি বাস তাদের পরিবহন সেবা প্রদান করে। অন্যদিকে সরকারি বিএম কলেজের ৩টি বাস কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৃক্ষরোপন কর্মসূচিতে অংশগ্রহন করে। চরকাউয়া ও চাদপুরা ইউনিয়ন পরিষদের সাধারন মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে এই কাজে অংশগ্রহন করে। তাছাড়া পুরো সড়কজুড়ে মনোরম পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কৃষ্ণচূড়ার চারা রোপণকারী দলের মাথায় লাল ফিতা, সোনালু চারা রোপণকারী দলের সোনালি ও জারুল গাছের চারা রোপণকারী দলের মাথায় বাঁধা থাকবে বেগুনি রঙের ফিতা বাধা ছিল। এছাড়াও নান্দনিকতা ফুটিয়ে তুলতে পর্যায়ক্রমে একেক খ-ে কৃষ্ণচূড়া, সোনালু এবং জারুল গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। কর্মসূচির প্রতিটি ব্লকের অংশগ্রহনকারীদের স্ব স্ব উদ্যোগে উৎসবের লেখা সম্বলিত বিভিন্ন রঙের গেঞ্জি পরিহিত ছিল অংশগ্রহনকারীরা। অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের উজ্জীবিত রাখতে এবং উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টির জন্য থাকবে একাধিক সাংস্কৃতিক ও বাদক দল তারা তাদের নৈপুন্যতা প্রর্দশন করেছেন। ।
এ ছাড়া দেশের প্রথম স্বীকৃত ফুল সরণি বিনির্মাণ অভিযানটি সরাসরি জেলা প্রশাসনের ফেসবুক টিভিতে সম্প্রচার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, চারা রোপণের ৩ বছরের মধ্যে মহাসড়কের ওই অংশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এক অপরূপ স্থান হয়ে উঠবে। বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ফুল সরনির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। প্রসঙ্গত, গত মে মাসে জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটির সভায় সর্বসম্মতভাবে জনগণের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ‘ফুল সরনি’ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য চারা ও আনুষাঙ্গিক ব্যয় বাবদ ২ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। বরিশাল ফুল সরণি বির্নিমানে বৃক্ষরোপন কার্যক্রম সকাল ১০ টা থেকে শুরু হয়ে দুপুর ১ টায় শেষ হয়।