স্বাধীন দেশে আমরা সুযোগ সন্ধানীরা বা তথাকথিত যোগ্যরা ভালোই আরামে আছি। প্রায় সকলেই নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। বিসিএস ক্যাডার হোক আর বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষকই হোক; শুধুই নিজ, নিজের বউ-বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত আমরা। তবে সবাই একরকম হয় না। ভিন্ন ধাঁচের মানুষ সমাজে আছে বলেই বাংলাদেশ এখনো পথ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়নি। এমনই একজন, জাতীয় বীর শহীদ পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল করিম।
গুলশানের হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলায় জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন এসি রবিউল। রবিউলের সঙ্গে নিজেদের একটু মিলিয়ে দেখি চলুন। আমরা কয়জন এমন আছি যে, অন্য মানুষের উপকার হবে ভেবে রাস্তার উপর পড়ে থাকা একটা কলার খোসাও হাতে ধরে ডাস্টবিনে ফেলেছি? রবিউল একটু ‘চালাক’ হলে সেদিন মারা যেতেন না। কিন্তু রবিউল সেদিন ‘চালাকির’ নামে পেশা ও দেশের সঙ্গে বেঈমানি করেননি। পেশাগত মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যদের একা রেখে চলে গেছেন অন্য জগতে। গুলশানের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় শহীদ রবিউল ও অন্যান্য পুলিশ অফিসারদের দেশের মানুষ ভালোবেসে তাই ‘জাতীয় বীর’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনযজ্ঞকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের মত আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর আর আত্মপ্রেমিকদের দিয়ে কি আর এই ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ সফল হবে? আমাদের বয়সী বা কাছাকাছি বয়সের অনেকের ‘কষ্ট’, যে তারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেননি! অলস আর স্বার্থপরের মত সময় পার করলে জীবনেও এই ‘দুঃখ’ যাবেনা। আর আমারা সেই সময় থাকলে যে মুক্তিযোদ্ধাই হতাম তার কোনো নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারবেনা। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বয়সী অনেকে রাজাকারও ছিল। যাইহোক, মুক্তিযুদ্ধে যেতে না পারার ‘আফসোস’ থেকে এখন যদি আমরা সততা, নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা নিয়ে যার যার দায়িত্ব পালন করি তাহলে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে’ জাতির জনক কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব কিছুটা হলেও পালন করতে পারব। কিন্তু আমাদের মধ্যে ‘শিক্ষিত’ অনেক হলেও সৎ মানুষ খুব কম। এখানেই রবিউলের বড়ত্ব। আবারো বলছি, রাষ্ট্রের সেবায় রবিউল নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাই রবিউল কোনো সাধারণ মানুষ নন। তেমনি তার স্ত্রী, সন্তানেরাও আর সাধারণ কেউ নন। তাই তাদের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক।
রবিউল দেশের অন্যতম প্রধান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। বিসিএস দিয়ে পুলিশে জয়েন করেছিলেন। শাহাদাত বরণ করে রবিউল তাঁর প্রিয় জাহাঙ্গীরনগরকে ভীষণ কষ্টমাখা গৌরবের বানে ভাসিয়েছেন। তাঁর পরিবার, শিক্ষক, সহপাঠী, হল ও ক্যাম্পাসের বড় ভাই, ছোট ভাই, বন্ধুরা সবাই অনেক কেঁদেছেন। কিন্তু বীর রবিউল যে শুধু আর জাহাঙ্গীরনগর কিংবা বাংলাদেশ পুলিশের রইলেন না, সেটা বোঝা গেল, জাহাঙ্গীরনগরে তাঁর স্ত্রীর চাকরি পাওয়ার বিষয়টি সামনে আসাতে। এমন সব মানুষ এই চাকরি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন যাদের সঙ্গে অতীত কিংবা বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগরের সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। আমার বন্ধু মশিউর রহমান মিলন, যার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এএফ রহমান হলে ৬ বছর পাশাপাশি কাটিয়েছি, ক্ষুব্ধ হয়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছে কেন রবিউলের স্ত্রীকে প্রথমেই ‘কাঙ্ক্ষিত চাকরি’ দেয়া হয়নি? মিলন একজন নন-জাহাঙ্গীরনগরিয়ান, যে কিনা ঢাকার বেসরকারি ব্যাংকের ব্যস্ত কর্মকর্তা, সে যখন ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিক্রিয়া দেখায় তখন বুঝতে হবে রবিউলের পরিবারের বিষয়টি জাতীয় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের জীবন এখন দুইটা- অনলাইন আর অফলাইন। দুই জীবন আলাদা হয়েও আলাদা নয়, বরং একটা আরেকটার পরিপূরক; নেতিবাচক দিক বিবেচনা করলে, একটা আরেকটার নিয়তি নির্ধারক। ফেসবুক, ইউটিউবকে পাশ কাটিয়ে দায়িত্বশীল মানুষের জীবন-সংসার সহজ, সাবলীলভাবে আর চলবেনা। ফেসবুক কীভাবে দাবানল হয়ে উঠে তার প্রমাণ শুধু রবিউল ইস্যু নয়, এর আগে আমরা শাহবাগের গণজাগরণের সময়ও দেখেছি। রবিউলের পরিবারের জন্য স্থায়ী কিছু একটা করার চেষ্টা করছিলেন জাহাঙ্গীরনগরের সাবেক-বর্তমান অনেক শিক্ষার্থী। বিশেষ করে তাঁর ব্যাচম্যাট ও বন্ধুদের আকুতি ছিল অনেক। এই পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রকাশ্য কোনো সম্পৃক্ততা নেই, আগেই বলে রাখছি।
ক্যাম্পাসের ভেতরে এবং বাইরে প্রচণ্ড জনমত তৈরি হলে প্রশাসন থেকে সিদ্ধান্ত হয় যে রবিউল করিমের স্ত্রী উম্মে সালমাকে চাকরি দেয়া হবে। আমি নিজেও আম আদমির মত পত্রিকা মারফত সে খবর পেয়ে খুশি হয়ে কয়েকদিন আগে সে নিউজ শেয়ার করেছি। বৃহস্পতিবার রাত থেকে ফেসবুকে খেয়াল করছিলাম, যে চাকরি দেয়া হয়েছে তাতে সকলে খুবই ক্ষুব্ধ। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ফেসবুক উত্তাল। দাবানলের আগুনের মত ক্ষোভ বাড়ছিল মানুষের মধ্যে। জাহাঙ্গীরনগরের সাবেক ছাত্র, দেশের সিনিয়র সাংবাদিক নুর সিদ্দিকীর একটি পোস্ট থেকে জানতে পেরে খ্যাতিমান সাংবাদিক শরিফুল হাসান আরেকটা পোস্ট দেয়। ইউরোপ প্রবাসী বড় ভাই মারুফ মল্লিকের পোস্টও বেশ সাড়া ফেলে। নানা পেজে আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন নেতা পর্যন্ত এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন।
আমার মত অজনপ্রিয় মানুষের কোনো কোনো পোস্টে যেখানে সারাদিনে ২০০/২৫০ লাইক পড়ে, সেখানে শরিফুল হাসানের পোস্ট মানে একটা বড় দাবানল। ২০/২৫ মিনিটে হাসানের পোস্টে হাজার লাইক, কমেন্ট পড়ে, শেয়ার হয়। মন্ত্রী, এমপি বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো বড় কর্মকর্তা কিংবা ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি না হয়ে এত মানুষের প্রিয়তা অর্জন করা সাধারণ ব্যাপার নয়। যাইহোক, উম্মে সালমাকে ‘ডেইলি বেসিস’ এ তৃতীয় শ্রেণির চাকরি দেয়া হয়েছে মর্মে ফেসবুকে নিয়োগপত্রের ছবিসহ প্রচার চলতে থাকে। সাবেক-বর্তমান ছাত্র-ছাত্রী অনেকে ক্ষেপে যায়। আগে মানুষের ক্ষোভ বুঝতে দেরি হত, ফেসবুক এসে এ সমস্যার সমাধান করেছে। অবশেষে রবিউলের অবদান, আত্মত্যাগ এবং পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে উম্মে সালমাকে প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদে চাকরি দিয়ে সম্মানিত করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর নিজেও একজন বীরের পরিবারের জন্য কিছু করতে পেরে সম্মানিত হয়েছে বলে আমি মনে করি।
কিন্তু কী আশ্চর্য! গুটিকয়েক মানুষের কাছে এখনো প্রথম দেয়া চাকরিই প্রধান ইস্যু হয়ে আছে। এই মানুষগুলো নানা কায়দা-কৌশল করে, ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রথম দেয়া চাকরির জন্য উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামকে এককভাবে দোষারোপ করে চলেছে। উপাচার্যকে ধন্যবাদ দিয়ে পোস্ট দেয়াতে আমাকে ইনবক্সে, প্রকাশ্যে বেশ বাজে কথা শুনতে হয়েছে। একজন উপাচার্য কি সব সিদ্ধান্ত একা নিতে পারেন? আরও অনেক মানুষ দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন। সবারই ভূমিকা থাকে। অথচ এত সুন্দর একটা কাজের পরেও উপাচার্যসহ পুরো শিক্ষকসমাজকে গালিগালাজ করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের একজন সদস্যকে দেখলাম উপাচার্যকে শুধু নয়, তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পর্যন্ত অশালীন কথা বলা হচ্ছে। এগুলো ব্যক্তিগত ক্ষোভ এবং বড় কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে করা হচ্ছে সেটা আমরা বুঝি। তাই অন্যদের সতর্ক থাকতে হবে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার আগে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সেটি সবসময় সর্বাবস্থায় বিবেচনায় নেয়ার জন্য উপাচার্য মহোদয়কে অনুরোধ করছি। কারণ সব সাফল্যের কৃতিত্ব আপনাকে দিতে আমাদের কার্পণ্যবোধ থাকলেও, সব ব্যর্থতায় আপনাকে পূর্ণ দোষারোপ করার বেলায় আমাদের অনেকের কোনো সংকোচ থাকে না।
আরও দুঃখের বিষয় হল, দু’একজন শিক্ষককেও দেখলাম রবিউলের স্ত্রীকে চাকরি দেয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না। এতে ছাত্র-ছাত্রীদের মনে পুরো শিক্ষক কমিউনিটি সম্পর্কে ভুল ধারণার জন্ম নিচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, রবিউলের স্ত্রীকে জাহাঙ্গীরনগরে কেন চাকরি দিতে হবে! আরে ভাই, রবিউল কে, সে কী করেছে সেটাতো আগে বোঝার চেষ্টা করুন। খালি ‘জাবিয়ান’ ‘জাবিয়ান’ বলে সবকিছুতে গলা ফাটালে হবে না। আমাদের সাত জনমের ভাগ্য যে রবিউল জাহাঙ্গীরনগরে পড়েছিল। রবিউল যদি আজ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত তাহলে এই আমাদের এত নিরাপদ ‘গৌরববোধ’ কোথায় যেত? রবিউল এর পরিচয়ে আমরা বলতে পারব, দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আমাদের জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থী ছিলেন। বাংলাদেশ পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি দপ্তর যেখানে শহীদ রবিউলের পরিবারের জন্য যথাযথ চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেননি, সেখানে জাহাঙ্গীরনগর এমন একটি কাজ করেছে যার সুফল রবিউলের পুরো পরিবার এবং ভবিষ্যৎ বংশধররাও পাবে। যে ক্যাম্পাসের আলো-বাতাসে রবিউল পড়ালেখা করেছে, এখন থেকে সে ক্যাম্পাসে বড় হবে তাঁর সন্তান! এর চেয়ে শান্তির বিষয় আর কী হতে পারে।
তবে এতে কেউ এককভাবে কৃতিত্বের দাবিদার নয়। পুরো জাহাঙ্গীরনগর, সাবেক-বর্তমান সব শিক্ষার্থী, ক্যাম্পাসের বাইরের কয়েকজন সাংবাদিক এবং অবশ্যই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সবাই, এখানে কৃতিত্বের অধিকারী। ফেসবুকে লিখে আপনি কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন আর যিনি এই চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন তাকে কৃতিত্ব দিতে পারেননা, তা কেমন করে হয়? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অল্প সময়ের ব্যবধানে সঠিক সিদ্ধান্ত আসাতে কিছু মানুষের মন খারাপ হয়েছে। প্রথম চাকরিকে কেন্দ্র করে যে জনক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল সেটাকে ইস্যু করতে না পেরে কি তাহলে অনেকের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে?
অনাকাঙ্ক্ষিত প্রক্রিয়ায় যদি বদনাম করতে পারেন, তাহলে ভালো কাজের জন্য প্রশংসা কেন করতে পারবেন না? ভালো কাজ নিয়ে গৌরববোধ করা, একটা বড় মহৎকাজের অংশ হিসেবে নিজেকে ভাবার জন্যও মানসিক সামর্থ্য থাকতে হয়। দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা, বীর শহীদ রবিউল যখন আকাশ থেকে দেখবেন তাঁর স্ত্রী, বাচ্চারা জাহাঙ্গীরনগরের সবুজ মাঠে, টারজান পয়েন্টে, চৌরঙ্গীর মোড়ে, জয়বাংলা গেইটে, শহীদ মিনারে নিরাপদে ঘুরে-বেড়াচ্ছে তখন কী যে শান্তি অনুভব করবেন সেটা ভাবতেই চোখ ভিজে যাচ্ছে। তাই কিছু না করেও, স্বার্থপরের মত জীবন যাপন করেও আমি অনেক গর্বিত যে, রবিউল জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র ছিলেন এবং আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। চলুন সবাই এই ঘটনায় গৌরববোধ করি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়